১০ ডিসেম্বর: বিএনপি অনমনীয়, সরকারও কঠোর

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৭, ২০২২; সময়: ১:০৬ অপরাহ্ণ |
১০ ডিসেম্বর: বিএনপি অনমনীয়, সরকারও কঠোর

পদ্মাটাইমস ডেস্ক :  ডিসেম্বরের ১০ তারিখ যত ঘনিয়ে আসছে, ঢাকার সমাবেশস্থল নিয়ে বিএনপি ও সরকারের মধ্যে দূরত্ব ততই প্রকট হচ্ছে। বিএনপি নয়া পল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সেই সমাবেশ করতে চাইছে। আর পুলিশ বলছে, তারা কোনোভাবেই সড়কে জনসভা করতে দেবে না। বিএনপিও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কোনোভাবেই যেতে চাইছে না।

দুই পক্ষের অনমনীয় অবস্থানে উদ্বেগও দেখা দিয়েছে, যার প্রতিফলন ঘটেছে যুক্তরাজ্যের এক সতর্কবার্তার মধ্যে। দেশটি তার দেশের নাগরিকদের ১০ নভেম্বর বাংলাদেশে চলাফেরায় সতর্ক থাকতে বলেছে।

তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আশা করছেন, শেষ পর্যন্ত বিএনপি সমঝোতায় আসবে এবং উদ্বেগেরও প্রশমন ঘটবে।

তবে পুলিশ ও বিএনপি নেতাদের সর্বশেষ কথায় সমঝোতার কোনো আভাস দেখা যাচ্ছে না।

নির্দলীয় সরকারের দাবি জানিয়ে আসা বিএনপি নির্বাচনের বছর আগে দেশের বিভাগে বিভাগে সমাবেশ শুরু করেছিল গত অক্টোবরে। বিভিন্ন বিভাগ শেষে ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় সমাবেশ করবে বলে জানায় তারা।

গণপরিবহন বন্ধ করাসহ নানা ধরনের হয়রানির অভিযোগের মধ্যেই বিভাগীয় সমাবেশগুলো করে তারা। এরপর ঢাকায় সমাবেশ নয়া পল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে করতে পুলিশের অনুমতি চায় দলটি।

তবে সরকার ও পুলিশের পক্ষ থেকে বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে বলার পর শুরু হয় টানাপড়েন। এর মধ্য গত রোববার বিএনপি নেতারা ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে দেখা করার পর বরফ গলার ইঙ্গিত মিলেছিল।

পুলিশের পক্ষ থেকে সমাবেশের জন্য সম্ভাব্য স্থান হিসেবে মতিঝিল, আরামবাগ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কথা বলা হয়েছিল সেদিন। তারপর বিএনপিও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিকল্প ‘গ্রহণযোগ্য’ স্থান পেলে তা বিবেচনার আশ্বাস দেয়।

কিন্তু এর একদিন বাদেই দৃশ্যপট কিছুটা বদলে যেতে দেখা যায়। সমাবেশের চার দিন আগে ডিএমপির পক্ষ থেকে বলা হয়, কোনো সড়কে সমাবেশ করতে দেওয়া হবে না। বিপরীতে বিএনপিও নয়া পল্টনের বাইরে যেতে অনমনীয় অবস্থানের কথা জানাচ্ছে।

এই পরিস্থিতিতে মঙ্গলবার যুক্তরাজ্য তাদের নাগরিকদের ১০ ডিসেম্বর সতর্কতার সঙ্গে চলাফেরার পরামর্শ দিয়েছে।

বিএনপির অন্য বিভাগীয় সমাবেশগুলোর আগে পরিবহন ধর্মঘট দেখা গেলেও ঢাকার সমাবেশের আগে তেমন কোনো কর্মসূচি দেওয়ার ইঙ্গিত মেলেনি বাস মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর কাছ থেকে।

রাস্তায় সমাবেশ নয়: পুলিশ

বিএনপির সমাবেশ কোথায় হবে, তা নির্ধারণের ভার পুলিশকেই দিচ্ছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তবে তিনি আশা করছেন, বিএনপি তাদের অবস্থান পরিবর্তন করবে।

মন্ত্রী মঙ্গলবার বলেন, “এরই মধ্যে সাধারণ মানুষের মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে যে সবাই যখন সোহরোওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করছে, বিএনপির কী উদ্দেশ্যে রাস্তা বন্ধ করতে চায়।

“আমি তো মনে করি, ওরা ফাইনালি একটা সেটেলমেন্টে আসবে। আমরা তো মনে করি না ওরা গোঁ ধরে বসে থাকবে। আমরা তো বলেছি, তোমরা মাঠে যাও, কয়েকটি মাঠ দেখিয়ে দিয়েছি।”

যদি বিএনপি তাদের অবস্থানে অটল থাকে, তা হলে সমাবেশে নিষেধাজ্ঞা জারির সম্ভাবনা আছে কি না- এমন প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, “বিষয়টি ডিএমপি পুলিশ কমিশানার জানেন, তিনি চিন্তা করবেন। তার দায়িত্ব যেটা সমস্ত ব্যবস্থা উনিই করবেন, যা নির্দেশনা উনিই দেবেন।”

এর মধ্যে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (মিডিয়া) ফারুক হোসেন বলেন, কোনোভাবেই তারা রাস্তায় বা আবাসিক এলাকায় সমাবেশের অনুমতি দেবেন না।

“বিএনপিকে সমাবেশ করতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে সেখানে সব ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থাও সাজিয়েছি আমরা। পুলিশ কখনও কাউকে রাস্তায় সমাবেশ, অবস্থান করতে দেবে না। কেউ সেই চেষ্টাও যেন না করে। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার কথা ভেবে পুলিশ সব ব্যবস্থা নেবে।”

সমাবেশকে কেন্দ্র করে ‍বিএনপি তাদের অবস্থান থেকে সরে না আসলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক।

তিনি বলেন, “আমরা আশা করছি, তারা দেশের আইন মেনে চলবে। তবে নিষেধাজ্ঞা না মানলে বা আইন মেনে না চললে প্রচলিত আইনে যা ব্যবস্থা, সেটা নেওয়া হবে।”

ঢাকা মহানগর পুলিশকে আইনে এই ক্ষমতা দেওয়া আছে, জননিরাপত্তা বজায় রাখার স্বার্থে তারা যে কোনো সভা-সমাবেশ বন্ধ করে দিতে পারে।

সমাবেশ হবেই: ফখরুল

সমাবেশের স্থান নিয়ে জটিলতার মধ্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মঙ্গলবার এক গোলটেবিল আলোচনায় কর্মীদের উদ্দেশে বলেন, “১০ ডিসেম্বর নিয়ে কোনো দ্বিধা রাখবেন না মনে। ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় সমাবেশ হবেই।”

তিনি এর আগেও বলেছিলেন, নয়া পল্টনে সভা করতে পুলিশের অনুমতির তোয়াক্কা করবেন না তারা।

বিএনপির প্রচার সম্পাদক ও বিভাগীয় সমাবেশ প্রস্তুতি কমিটির সদস্য শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি বলেন, “আমরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করব না। বিকল্প হিসেবে আমরা (মতিঝিল) আইডিয়াল স্কুলের সামনের সড়কটি চেয়েছি। আমরা স্থান দেখেও এসেছি। ডিএমপিও স্থানটি দেখেছে।

“আমরা বলেছি, বিকল্প স্থানটি ডেড সড়ক। শনিবার এমনিতে এ সড়কে যান চলাচল করে না। আমরা আমাদের বিকল্প স্থানের কথা পুলিশকে জানিয়ে দিয়েছি।”

অন্যদিকে পুলিশ উপ কমিশনার হায়াতুল ইসলাম খান বলেন, “তারা আইডিয়ালের কথা মৌখিকভাবে বলেছিলেন। কিন্তু রাস্তায় বা আবাসিক এলাকায় সমাবেশ করা যাবে না।”

বিএনপি এখন কী করবে জানতে চাইলে এ্যানি বলেন, “আমরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান চাইনি, আবেদনও করেনি। সেখানে আমরা কোনো প্রোগ্রাম করব না- এটা আমাদের স্ট্যান্ড।

“আমরা আশাবাদী, যে বিকল্প জায়গাটির কথা বলেছি, সেখানে সমাবেশ করার বিষয়ে আমাদের পুলিশ সহযোগিতা করবেন। বিকল্প স্থানে না দিলে নয়া পল্টনের সড়কেই হবে। আমরা শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করতে চাই। যদি না দেওয়া হয়, তার দায় তাদের ওপর বর্তাবে।”

তবে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হাফিজ আক্তার বলেন, বিএনপির অবস্থান বদলাবে বলে তারা আশা করছেন।

“প্রতিদিনই কথা হচ্ছে (বিএনপি’র সাথে) আজও কথা হয়েছে। আশা করি তারা নমনীয় হবেন। এখনও যথেষ্ট সময় আছে এবং তাদের সাথে আলোচনা চলছে।”

উভয়কে নিয়ে উভয়ের সন্দেহ

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রাজনৈতিক সমাবেশ হলেও বিএনপি কেন সেখানে যেতে চাইছে না, তা নিয়ে নানা সন্দেহ রয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতাদের মনে।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, “সোহরাওয়ার্দীতে না চাইলে তারা বাণিজ্য মেলার মাঠ বা আরও বড় বিশ্ব ইজতেমার মাঠ যেখানে ২০ লাখ মানুষ ধরে, না হলে কামরাঙ্গীর চরের মাঠেও যেতে পারে।

“তারা সেটা বলে না, বলে এই রাস্তা না হয় ওই রাস্তা। মতিঝিলের রাস্তা যেখানে অনেক ব্যাংক, বীমা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে, সেটি কেন তাদের এত পছন্দ। এটির পেছনেও গভীর ষড়যন্ত্র, দুরভিসন্ধি আছে। প্রকৃতপক্ষে তারা কোনো জনসভা করতে চায় না, এটিকে ইস্যু বানাতে চায় এবং দেশে একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টায় তারা আছে।”

বিএনপিকে হুঁশিয়ার করে তিনি বলেন, “আমাদের সরকার দেশে কাউকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে দেবে না। আমাদের নেতাকর্মীদেরও কর্তব্য আছে। ১০ ডিসেম্বর কেউ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালালে আমাদের নেতাকর্মীরা দেশের মানুষকে সাথে নিয়ে তাদেরকে প্রতিহত করবে।”

অন্যদিকে বিএনপি নেতা এ্যানি বলছেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান তারা নিজেদের জন্য নিরাপদ মনে করছেন না।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে না যাওয়ার কারণ দেখিয়ে বিএনপির সমাবেশ প্রস্তুতি কমিটির উপ সমন্বয়কারী আমান উল্লাহ আমান এর আগে বলেছিলেন, “সোহরাওয়ার্দী উদ্যান চতুর্দিকে ঘেরা, লোকজন প্রবেশের একটা মাত্র ছোট গেইট। বেরুনোর পথও সেই গেইট। ফলে এখানে আমাদের সমাবেশ করা সম্ভব নয়।”

বিএনপির এই সমাবেশ ঘিরে ক্ষমতাসীনরা চক্রান্ত করছে বলেও অভিযোগ করছেন বিএনপি মহাসচিব ফখরুল।

তিনি মঙ্গলবার এক গোলটেবিল আলোচনায় বলেন, “সরকার হীন চক্রান্ত আবার শুরু করেছে। আমরা ইতিমধ্যে পত্র-পত্রিকায় দেখেছি, বিভিন্নভাবে খবরও পেয়েছি যে, প্রায় ২শটা না কি বাস রেডি করা হয়েছে পুড়িয়ে দেওয়ার জন্য।

“আমরা শুনেছি, ইতিমধ্যে কিছু আলামতও আমরা পেয়েছি যে, ছাত্রলীগ নামধারী, যুবলীগ নামধারী কিছু সন্ত্রাসীকে প্রত্যেকটি ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে, থানায় থানায় নামিয়ে দিয়েছে।”

সমাবেশ ঘিরে বিএনপি-আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি চললেও ওবায়দুল কাদের আশাবাদী, এই জটিলতা কেটে যাবে।

মঙ্গলবার ভারতের হাই কমিশনার প্রণয় ভার্মার সঙ্গে বৈঠকের পর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “যেটাই হোক, একটা সমঝোতায় আসবে।”

“হয়ে যাবে (সমাধান)। বাংলাদেশের রাজনীতির আকাশে ঘন মেঘ ঘনীভূত হয়, আবার চট করে চলে যায়। আই অ্যাম অলওয়েজ অপটিমিস্টিক, আমি আশাবাদী,” বলেন তিনি।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে