রাজশাহীতে ব্র্যান্ডের মোড়কে নকল প্রসাধনীর ছড়াছড়ি

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৪, ২০২২; সময়: ১:৩৮ অপরাহ্ণ |
রাজশাহীতে ব্র্যান্ডের মোড়কে নকল প্রসাধনীর ছড়াছড়ি

তানজিলা চৌধুরী : নিত্যপণ্যের কথা বললে সাবান, শ্যাম্পু, ক্রীম, লোশন, পাউডার প্রসাধনী সামগ্রীর নামও চলে আসে এর মাঝে। কিন্তু বর্তমানে সেই প্রসাধনী বাজারে নকলের ছড়াছড়ি। সকল পণ্যেরই নকল দিয়ে সাজানো থাকছে ছোট বড় সব প্রসাধনী দোকানগুলো। দেখে বুঝার উপায় নেই আসল নকলের পার্থক্য।

ঋতুভেদে ত্বকের সুরক্ষা ও বিশেষ যত্নের খাতিরে যে প্রসাধনী সামগ্রীই ব্যবহার করা হোক না কেন, তা অবশ্যই মানসম্পন্ন হতে হয়। শরীরে ও ত্বকের যত্নে ব্যবহৃত পণ্য মানসম্পন্ন না হলে মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। তবে বর্তমানে বাজারে শরীরে ব্যবহৃত সব ধরণের প্রসাধনী পণ্যেই রয়েছে ভেজাল। পৃথিবীর নামকরা প্রায় সব ব্র্যান্ডের প্রসাধনী সামগ্রীর নকল পণ্য দিয়ে সাজানো হচ্ছে ছোট-বড় সব প্রসাধনী দোকানগুলো। পণ্যগুলো দেখে আসল নকল পার্থক্য বুঝা দায় হয়ে পড়ছে ক্রেতাদের।

সাবান, শ্যাম্পু, ময়েশ্চারাইজার, লোশন, কেশতেল, মেহেদি, ফাউন্ডেশন, লিপস্টিক,বডি স্প্রেসহ সবধরনের পণ্যেরই মিলছে নকল। নকল পণ্যগুলোর প্যাকেটে আসল আমদানিকারকের স্টিকারের মতো হুবহু স্টিকারও লাগানো রয়েছে। সেই সাথে রয়েছে উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্নের তারিখ এবং সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের ছাপ। এসব দেখে যে কেউই আসল নকল চেনার ক্ষেত্রে পড়ে যান বিপাকে।

ভোক্তাদের বিপুল চাহিদাকে পুঁজি করে কতিপয় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী নকল ও মানহীন প্রসাধনী সামগ্রী বাজারজাত করছে। অনৈতিক মুনাফা হাতিয়ে নেওয়ার সাথে শিশুসহ সব বয়সী মানুষকে ঠেলে দিচ্ছে বিরাট ক্ষতির মুখে। ফুটপাত থেকে শুরু করে বাজারের বড় নামীদামী দোকানগুলোতেও সরবরাহ করা হচ্ছে এসব ভেজাল ও নকল সামগ্রী।

রাজশাহী মহানগরীর সাহেব বাজার আরডিএ মার্কেট, সামনের ফুটপাতের দোকান, নিউ মার্কেটসহ বিভিন্ন বাজার ও দোকানে ঘুরে দেখা যায় এই অবস্থা। সেইসাথে গ্রাম-গঞ্জে ফেরি করেও বিক্রি করা হচ্ছে ক্ষতিকর এসব প্রসাধনী।

হ্যাভক, ফগসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বডি স্প্রের দাম ১৮০ থেকে ২৫০ টাকার মধ্যে। যেখানে আসলগুলোর দাম ৫০০ থেকে ৮০০ টাকার মধ্যে। নামকরা বিভিন্ন বিদেশী কোম্পানির যেসব পণ্যের দাম ১৯০০ থেকে ২৩০০ এর মধ্যে নগরীর আরডিএ মার্কেটে সেসব পণ্যের দাম ৫৫০ থেকে ৮০০ টাকার মধ্যে।

ফিট মি ফাউন্ডেশন (মেকআপ সামগ্রী) বিক্রি হচ্ছে ৫৫০ টাকায় যার আসলটির মূল্য প্রায় ১৮০০ টাকা। আবার একই পণ্য বিভিন্ন দামেও বিক্রি করতে দেখা যাচ্ছে।

বিক্রেতারা বলছেন কোনোটি উন্নতমানের, কোনোটি তেমন ভালো নয়। আবার এর মাঝে দেশী, চায়নার পার্থক্যও রয়েছে। ক্রেতার সামর্থ্য ও চাহিদা অনুযায়ী তারা একই পণ্য বিভিন্ন মূল্যের দেখান।

এই বিষয়ে আরডিএ মার্কেটের প্রসাধনী দোকানে বাজার করতে আসা তন্বী রহমান জানান, ‘আসল নকল বুঝা এখন দায়। লেভেল,প্যাকেজিং সব একই করে ফেলে কিভাবে বুঝবো আসল নাকি নকল কিনছি। তাছাড়া বাজারে এখন সবকিছুর দাম বেশি। আমাদের মত শিক্ষার্থীদের পড়তে হয়েছে বিপদে। বাসা থেকে বারবার এতো টাকাও চাওয়া যায় না, আবার কিছু জিনিসতো না কিনলেই নয়। এক্ষেত্রে অনেক সময় নকল পণ্য বুঝলেও বাধ্য হয়েও কিনতে হচ্ছে উর্ধ্বগতির চাপে।’

আরেক ক্রেতা জ্যোতি আহম্মেদ জানান, ‘নকল পণ্যের দাম কম। যা রেপ্লিকা বলে এখন দায়মুক্ত ভাবে সহজেই বিক্রেতারা ক্রেতাদের দেখাচ্ছেন। আমরাও খরচ কমাতে কিনে নিচ্ছি রেপ্লিকা শুনে। রেপ্লিকাও যে নকলের আওতায় পড়ে তা ভুলে যাচ্ছি। তাছাড়া দাম বেশি হলেও যে আসল পণ্যই দিচ্ছে তারও সত্যতা নেই। বেশি দামে কিনেও নকল পণ্যের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। বিক্রেতারা লাভের আশায় নকল পণ্যকে আসল বলেই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। আর আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।’

তবে এই বিষয়ে বিক্রেতাদের দাবী ক্রেতারা জেনে শুনেই রেপ্লিকা পণ্য কিনছেন কম দামে বেশি পণ্য পাওয়ায়। আসল দামী পণ্য দেখালেও ক্রেতারা সেই পণ্য কম দামে খুঁজেন। তাই ব্যবসা রক্ষার্থে তাদের এসব রেপ্লিকা পণ্য আনতে হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরডিএ মার্কেটের এক বিক্রেতা বলেন, ‘বেশি দামে কে কিনতে চায়, সবাই তো খুঁজে কম দামে। আমরা কম দামে বিদেশী আসল পণ্য কিভাবে দিব। তাই চায়না পণ্য রাখি। এতে যদি আমরা দোষী হই, সমান দোষী ক্রেতারাও। তারাও জেনে বুঝে ক্রয় করে।

আরডিএ মার্কেটের আরেক বিক্রেতা জানান, ‘ঢাকার চকবাজার, মিরপুর থেকে এসব নকল পণ্য আসছে। ঢাকায় বিভিন্ন জায়গায় গড়ে উঠেছে নকল পণ্যের অত্যাধুনিক সব কারখানা। এসব কারখানায় এমন কোনো পণ্য নেই যা নকল তৈরী হয় না। চীন, ভারত, জার্মানি, থাইল্যান্ড, আমেরিকা ও জাপানের পণ্য ছাড়াও দেশি পণ্য অবিকল নকল করে তৈরি করা হচ্ছে।

তাছাড়া আসল পণ্য যেখানে ১৮০০ থেকে ২০০০ টাকায় বিক্রি হয় সেখানে এসব নকল পণ্য কম দামে কিনে এনে ৫৫০ থেকে ১০০০ টাকায় বিক্রি করা যায়। এতে অনেক সময় অর্থনৈতিক এই মন্দা অবস্থায় ক্রেতাও কম দামে প্রয়োজনীয় অনেক পণ্য কিনতে পেরে খুশি হয়ে যায়। তারা অনেক সময় বুঝেও কিনছে। কারণ এই উর্ধ্বগতিতে যেসব পণ্য না কিনেই নয় তা কম দামে পেয়ে যাচ্ছে।’

তিনি আরো জানান, ‘আসল পণ্য একটা কিনলেই যেখানে ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা চলে যায় সেখানে ১২০০ টাকায় তারা রেপ্লিকা পণ্যের কম্বো প্যাকেজ পেয়ে যাচ্ছে একসাথে অনেকগুলো। তাই আমরা আসল পণ্য দেখালেও তারাই কম দামে খুঁজে। তারাও জানে আসল পণ্য এতো কম দামে পাওয়া সম্ভব নয়।’
এছাড়াও তিনি আরো জানান, ‘রেপ্লিকা অনেক পণ্য আসলে চীনের কেমিক্যাল দিয়ে এদেশেই তৈরি হচ্ছে সেগুলো আমরা চায়না বলেই তুলনামূলক কম দামে বিক্রি করি। যারা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, থাইল্যান্ডের আসল পণ্য দামের জন্য নিতে পারছেন না তারা একই ব্র্যান্ডের চায়না পণ্য নিয়ে থাকেন।’

এসব প্রসাধনী ব্যবহারে ক্ষতিকর দিকগুলো বিষয়ে রাজশাহীর চর্ম ও যৌন রোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার তৌফিক তাওফি জানান, ‘নকল ও ভেজাল প্রসাধনীতে দেওয়া বিষাক্ত দ্রব্য রক্তের সাথে মিশে নানা ব্যাধির সৃষ্টি করে। এগুলো ব্যবহারের ফলে প্রথমে ত্বকে র‌্যাশের দেখা দেয়। পরে ধীরে ধীরে তা চামড়ায় ক্যান্সার ছাড়াও নানা ধরনের জটিল রোগ তৈরি করে। এসব পণ্যসামগ্রী ব্যবহারে নিজেদের সচেতনতার বিকল্প নেই।’

বাজারে নকল প্রসাধনী সামগ্রীর বিক্রির বিক্রির বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ পরিচালক মোহাম্মদ সেলিম বলেন, ‘পণ্যের মান যাচাই ও বাজার তদারকির জন্য আমরা প্রতিনিয়ত বাজারগুলোতে অভিযান চালাচ্ছি। এধরণের নকল পণ্য বিক্রয় দেখা মাত্রই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে সেই প্রতিষ্ঠান ও বিক্রয়কর্মীর বিরুদ্ধে। তাদের যথাযথ সাজার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এছাড়াও কেউ নির্দিষ্ট অভিযোগ করলে তা তদন্ত করে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি জরিমানা করা হচ্ছে।

 

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে