প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের প্রটোকল অফিসার পরিচয়ে প্রতারণার অভিযোগে গ্রেপ্তার ২
পদ্মাটাইমস ডেস্ক : প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের প্রটোকল অফিসারের ভুয়া পরিচয়ে বদলি বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি ও প্রতারণার মাধ্যমে কোটি টাকা আত্মসাৎ চক্রের দুই সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) ও র্যাবের যৌথ অভিযানে রাজধানীর বনানী থেকে সোমবার রাতে তাদের গ্রেফতার করা হয়। এদের একজন হরিদাস চন্দ্র ওরফে তাওহীদ ইসলাম (৩৪) ও অপরজন হলেন মো. ইমরান মেহেদী হাসান (৩৮)।
মঙ্গলবার রাজধানীর কারওয়ানবাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
র্যাব বলছে, হরিদাস চন্দ্র ওরফে তাওহীদ এ চক্রের ‘মূল হোতা’। হরিদাস চন্দ্র ধর্মান্তরিত হয়ে তাওহীদ ইসলাম নামধারণ করেন। দুজনের কাছ থেকে চারটি মোবাইল, জালিয়াতিতে ব্যবহার করা বিভিন্ন নথি এবং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এডিট করা ভুয়া ছবি জব্দ করা হয়েছে।
খন্দকার আল মঈন বলেন, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা গোয়েন্দা সূত্রে জানতে পারে, একশ্রেণির প্রতারক চক্র স্পর্শকাতর ব্যক্তিদের অথবা সমাজের বিভিন্ন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নাম ব্যবহার করে বা তাদের প্রটোকল অফিসার বা বিভিন্ন মন্ত্রীর ভুয়া এপিএস পদবি ব্যবহার করে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে অর্থ আত্মসাৎ করছে। এমনকি এ প্রতারক চক্র প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের ভুয়া প্রটোকল অফিসার পরিচয় দিয়েও বিভিন্ন স্থান থেকে অর্থ আত্মসাৎ করে প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সুনাম ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা করছে।
প্রতারক চক্রের প্রতারণাসহ নানা অপকর্মের বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে এনএসআই ও র্যাব-৩–এর যৌথ অভিযানে রাজধানীর বনানী এলাকা থেকে তাওহীদ ইসলাম ও মো. ইমরান মেহেদীকে গ্রেফতার করা হয়। তাওহীদ ইসলাম বগুড়ার শিবগঞ্জের উথলী বাজার গ্রামের গোপীনাথের ছেলে। মো. ইমরান মেহেদী হাসান ময়মনসিংহের ত্রিশালের নওদার গ্রামের মো. সাইফুল ইসলামে ছেলে।
সংবাদ সম্মেলনে র্যাব জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, প্রতারক চক্রের মূলহোতা তাওহীদ ইসলাম ওরফে হরিদাস চন্দ্র। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় অবৈধ উপায়ে ভারতে যান তিনি। সেখানে এক আত্মীয়ের বাসায় ছিলেন। আত্মীয়ের মাধ্যমে সেখানকার পঞ্চায়েতপ্রধানের কাছ থেকে কৌশলে এতিম সার্টিফিকেট গ্রহণ করেন। স্থানীয় একটি স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন।
এরপর ইলেক্ট্রনিক্স বিষয়ে দুই বছরের বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ২০১০ সালে বাংলাদেশে ফেরেন হরিদাস। রাজধানীর উত্তরায় পুরাতন এসি কিনে মেরামত করে বিক্রির দোকানে কাজ শুরু করেন। ২০১৮ সালে এক সবজি বিক্রেতার সঙ্গে সাবলেট বাসা ভাড়া নেন। ভাড়া থাকা অবস্থায় সবজি বিক্রেতার মেয়েকে বিয়ে করার জন্য ২০১৯ সালে ধর্মান্তরিত হন। এরপর হরিদাস চন্দ্র নিজের নাম বদলে রাখেন তাওহীদ ইসলাম।
তাওহীদ ইসলাম শ্বশুরের পরিচয়ে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া এলাকায় কিছু জমি কেনেন। এরপরই প্রচার করতে থাকেন, তিনি প্রধানমন্ত্রী পরিবারের সদস্যদের প্রটোকল অফিসার। এ পরিচয়ে স্থানীয় রাজনীতিবিদ এবং বিত্তশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পের প্রস্তাব দিতেন। এলাকার বিত্তশালী লোক এসব প্রকল্পে বিনিয়োগ করলে তাদের লভ্যাংশ প্রদান করা হবে বলে প্রলোভন দেখান।
এছাড়া প্রকল্প শুরু হলে তা সমাপ্ত করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের সহায়তায় বিভিন্ন সরকারি দপ্তর থেকে অর্থ এবং উন্নয়নমূলক কাজ সম্পন্ন করতে তাদের আশ্বস্ত করতেন। এছাড়া এসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন হলে এলাকার উন্নতি হবে বলে প্রলুব্ধ করতেন। তার প্রতারণায় প্রলুব্ধ হয়ে অনেকেই চাকরি, বদলি, টেন্ডারসহ বিভিন্ন বিষয়ে তদবির করার জন্য তার সহায়তা চাইতেন।
এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে চাকরিপ্রত্যাশী, পছন্দমতো জায়গায় বদলিপ্রত্যাশী সরকারি চাকরিজীবী, বিভিন্ন ক্রয়–বিক্রয় ও উন্নয়নমূলক কাজের টেন্ডারে অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের কাছ থেকে টাকার বিনিময়ে কাজ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করতে থাকেন। এ সময় ইমরান মেহেদী হাসান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে কর্মরত তার বিভিন্ন সহযোগী, বিভিন্নজনকে তাওহীদ ইসলামের কাছে নিয়ে আসতেন। সে সুযোগে তাওহীদ ইসলাম এসব ব্যক্তিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে বিভিন্ন পদে চাকরি, পদোন্নতি এবং বদলির বিষয়ে আশ্বস্ত করে তাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ করতেন। গ্রেফতার তাওহীদ ইসলামের চক্রে পাঁচ-ছয়জন সহযোগী রয়েছেন।
র্যাব জানায়, তার মোবাইলে বিভিন্ন নাম্বার প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের এবং নিকটাত্মীয়ের নামে লেখা আছে। প্রতারণার সময় সেসব নাম্বারে কল দিয়ে ভিকটিমকে প্রতারিত করে মোবাইলে প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের নাম দেখাতেন। ভিকটিমরা ওই নাম্বারকে প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যের নাম্বার মনে করে প্রতারিত হতেন। প্রকৃতপক্ষে তার কোনো রাজনৈতিক নেতা বা কর্মীর সঙ্গে পরিচয় নেই। তার কোনো দলীয় পরিচয়ও নেই। প্রতারণা করে অর্থ উপার্জনই তার মূল লক্ষ্য ও পেশা।
খন্দকার আল মঈন বলেন, ইমরান মেহেদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ক্যাশিয়ার। তিনিও নানা অপকর্মে জড়িত। বেসরকারি ক্লিনিকে চাকরি প্রদান, অনলাইনে নিবন্ধনের আবেদন, নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের নবায়নসহ অর্থ জালিয়াতির বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত থাকায় এ বছরের প্রথম দিকে তাকে বিভাগীয় শহর থেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বদলি করা হয়। এছাড়া অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে গত আগস্ট থেকে তিনি কর্মস্থলে গরহাজির থাকেন।
পরে তিনি তাওহীদ ইসলামের মাধ্যমে নিজের বদলি বাতিল করার চেষ্টা করেন। ইমরান মেহেদী কর্তৃপক্ষের মাধ্যম ছাড়া বিধিবহির্ভূতভাবে নিজের বদলি বাতিলের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আবেদন করেন। আবেদনের কপি তিনি তাওহীদ ইসলামকে দেখান।
তারপর তারা দুজনে এ কপির ওপর প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের এক সদস্যের নাম লিখে ভুয়া সিল দিয়ে একটি ভুয়া ডিও লেটার তৈরি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মোবাইলে অ্যাপসের মাধ্যমে প্রেরণ করে দ্রুত বদলির আদেশ বাতিল করে পূর্বের পদে বহালের জন্য সুপারিশ করেন। ডিও লেটারটি সন্দেহজনক মনে হওয়ায় কর্তৃপক্ষ এনএসআইয়ের কাছে অভিযোগ করে। অভিযোগের ছায়াতদন্তে ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়।
আসামিরাও জিজ্ঞাসাবাদে তাদের কৃতকর্মের বিষয়টি স্বীকার করেছেন বলে জানিয়েছেন র্যাবের এই মুখপাত্র। তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান খন্দকার আল মঈন।
