স্ত্রী থেকে স্বামী কতদিন দূরে থাকতে পারে?

প্রকাশিত: অক্টোবর ২৪, ২০২২; সময়: ১:৫২ অপরাহ্ণ |
স্ত্রী থেকে স্বামী কতদিন দূরে থাকতে পারে?

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : পবিত্র ও নির্মল এক সম্পর্কের নাম দাম্পত্য জীবন। এর সূচনা হয় বিয়ের মাধ্যমে। এই এক সম্পর্কের জেরে কত চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে দু’জন মানুষ পুরোটা জীবন কাটিয়ে দেন একসঙ্গে। পৃথিবীতে রেখে যান ভালোবাসা স্মৃতিচিহ্ন। বিয়ের মাধ্যমে শুধু দু’জন মানুষ এক হন না। একসাথে মিলে যায় দু’টি পরিবার। তৈরি হয় কিছু নতুন সম্পর্ক, সম্বন্ধ। সুস্থ সমাজ-ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ও চরিত্রকে নিষ্কলুষ রাখতে বিয়ের বিকল্প নেই।

প্রাপ্ত বয়স্ক নারী-পুরুষের বিয়ের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহহীন, তাদের বিয়ে সম্পাদন করে দাও এবং তোমাদের দাস ও দাসীদের মধ্যে যারা সৎকর্মপরায়ন, তাদেরও। তারা যদি নিঃস্ব হয়, তবে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদের সচ্ছল করে দেবেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ। যারা বিয়েতে সামর্থ্য নয়, তারা যেন সংযম অবলম্বন করে-যে পর্যন্ত না আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদের অভাবমুক্ত করে দেন। (সুরা নুর, আয়াত : ৩২-৩৩)

আল্লাহর রাসুল (সা.) যুবকদের বিয়ের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে বলেন, ‘হে যুব সম্প্রদায়! তোমাদের মধ্যে যে বিয়ের সামর্থ্য রাখে, সে যেন বিয়ে করে নেয়, কেননা তা চক্ষুকে সংযত রাখে এবং লজ্জাস্থান রক্ষা করে। (বুখারি, হাদিস : ৫০৬৬; মুসলিম, হাদিস : ১৪০০)

রাসুল (সা.) আরও বলেন, ‘যখন বান্দা বিয়ে করে, তখন সে তার দ্বীনের অর্ধেক পূরণ করে। অতএব, বাকি অর্ধেকাংশে সে যেন আল্লাহকে ভয় করে।’ (সহিহ আল-জামিউস সাগির ওয়া জিয়াদাতুহু, হাদিস : ৬১৪৮; তাবরানি, হাদিস : ৯৭২; মুসতাদরাক হাকিম, হাদিস : ২৭২৮)

পবিত্র কোরআনে দাম্পত্য জীবনকে আল্লাহর অনুগ্রহ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (স.) বিদায় হজের ভাষণে ইরশাদ করেছেন,

أَلَا إِنَّ لَكُمْ عَلَى نِسَائِكُمْ حَقًّا , وَلِنِسَائِكُمْ عَلَيْكُمْ حَقًّا

‘জেনে রাখবে, নিশ্চয়ই তোমাদের নারীদের উপর তোমাদের অধিকার রয়েছে, আর তোমাদের উপরও তোমাদের নারীদের অধিকার রয়েছে।’ পুরুষদেরকে উদ্দেশ্য করে অন্য হাদিসে প্রিয়নবী (স.) বলেন, ‘সাবধান, তোমরা নারীদের কল্যাণকামী হও..’ ( তিরমিজি: ৩০৮৭)

সুতরাং মুমিন পুরুষদের উচিত দাম্পত্য জীবনের ব্যাপারে সতর্ক ও যত্নবান হওয়া। এতে কোনও ধরনের অসৌজন্যতা ও খেয়ানত যেন না হয় সে বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া। কারণ, স্ত্রীর হক ঠিকমতো আদায় না করলে বা অবহেলা করলে স্বামীকে আল্লাহর কাঠগড়ায় জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে হবে।

হাদিসে এসেছে, হজরত ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনো করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘জেনে রাখ! তোমাদের প্রত্যেকেই একজন দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকেই তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। একজন পুরুষ তার পরিবার (স্ত্রী-সন্তানদের) উপর দায়িত্বশীল। সে তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।’ (মুসলিম, ৩০০৫)

এক হাদিসে হজরত মুয়াবিয়া ইবনে হায়দা (রা.) বলেন, ‘আমি জিজ্ঞাসা করলাম, হে আল্লাহর রাসুল, আমাদের প্রতি আমাদের স্ত্রীদের কী অধিকার আছে? রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তোমরা যখন খাবে তাদেরও খাওয়াবে, যখন খাবে তাদেরও খাওয়াবে, যখন তোমরা কাপড় পরবে তাদেরও পরতে দেবে। তাদের চেহারায় মারবে না, গালগন্দ করবে না। তাদের তোমাদের ঘরেই থাকতে দেবে, অন্য কোথাও না। ’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ২১৪২)।

বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রী সর্বদা কাছাকাছি থাকবে, এটাই স্বাভাবিক ধারা ও ইসলামী শরীয়তে এমনটাই কামনা করা হয়। তবে জীবিকার প্রয়োজন ও বিভিন্ন কারণে যদি (যেমন, জেহাদে যাওয়া কিংবা জীবিকা অর্জনের জন্য প্রবাসে যাওয়া) স্বামী দূরে কোথাও যায় তাহলে চার মাসের মধ্যে একবার হলেও স্ত্রীর কাছে ফিরে আসতে হবে। এমন মতামই দিয়ে থাকেন ইসলামী আইন ও ফেকাহশাস্ত্রবিদরা। কারণ নারীরা সাধারণত তাদের স্বামী থেকে চার মাস দূরে থাকতে পারে।

হাদিস শরিফে এসেছে,যায়দ বিন আলমাস (রহ.) বলেন, ‘এক রাতে হযরত উমর (রা.) জনগণের খোঁজ-খবর নেয়ার জন্য প্রহরী বেশে বের হয়ে গেলেন। এক বাড়ির পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় তিনি ঘর থেকে নারী কণ্ঠে কবিতা আবৃত্তি শুনতে পেলেন। ঘরের ভিতর এক মহিলা কবিতা আবৃত্তি করছিল। যার অর্থ হলো,রজনী দীর্ঘ হয়েছে এবং তার এক পার্শ কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করেছে। এদিকে দীর্ঘদিন যাবত আমার প্রেমাস্পদ আমার কাছে নেই যে,তার সাথে আমি আমোদ-প্রমোদ করব। আল্লাহর শপথ! যদি এক আল্লাহর ভয় না থাকত তাহলে এ খাটের চার পাশ নড়ে উঠত।

যখন ভোর হলো হযরত উমর (রা.) রাতের কবিতা আবৃত্তিকারিণী মহিলাকে ডেকে আনার নির্দেশ দিলেন। মহিলা খলিফার দরবারে এসে উপস্থিত হলে হযরত উমর (রা.) তাকে জিজ্ঞাসা করলেন,তুমি কি গত রাতে এ-জাতীয় কবিতা আবৃত্তি করেছিলে? মহিলা বলল,হ্যাঁ।

উমর (রা.) বললেন কেন? উত্তরে মহিলা বলল,দীর্ঘদিন যাবত আমার স্বামী জিহাদের ময়দানে রয়েছে। অথচ এমুহূর্তে তার নৈকট্য পাওয়া আমার একান্ত কাম্য ছিল,তার বিরহেই আমি এমনটি করেছি৷ হযরত উমর (রা.) এ কথা শুনে তখনই ঐ মহিলার স্বামীর নিকট ফিরে আসার নির্দেশনা দিয়ে শাহী ফরমান প্রেরণ করলেন।

এরপর তিনি তার কন্যা হযরত হাফসা (রা.) এর নিকট গিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন,হে আমার মেয়ে! নারীরা তাদের স্বামী থেকে কতদিন পর্যন্ত ধৈর্য ধারণ করে থাকতে পারে? (প্রজাদের স্বার্থ রক্ষার ইচ্ছা যদি না হত তবে আমি তোমার নিকট এরুপ প্রশ্ন করতাম না) তখন হাফসা (রা.) বললেন, মেয়েরা তাদের স্বামী থেকে চার মাস পর্যন্ত ধৈর্য ধারণ করে থাকতে পারে। এরপর থেকে হযরত উমর (রা.) চার মাস পরপর মুজাহিদ বাহিনীকে ফেরত নিয়ে আসতেন এবং নতুন বাহিনী পাঠিয়ে দিতেন।’ –(মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদিস: ১২৫৯৪)

তাই চার মাসের অধিক সময় স্ত্রী থেকে দূরে থাকা শরিয়ত সমর্থন করে না।

তবে কেউ যদি প্রয়োজনে এরচেয়ে বেশি সময় দূরে থাকতে চায় তাহলে তার স্ত্রী থেকে অনুমতি নিতে হবে। স্ত্রী যদি অনুমতি দেয় এবং এ সময়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে বলে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করে এবং বাস্তবেও তেমনটি দেখা যায় তাহলে স্বামী এরচেয়েও বেশি সময় দূরে থাকতে পারবে।

তবে যদি স্ত্রী থেকে দূরে থাকার কারণে স্বামী বা স্ত্রী কোনো গুনাহে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে তাহলে চার মাসের কম সময়ও স্ত্রী থেকে দূরে থাকতে পারবে না। (সুনানে নাসায়ি, হাদিস: ৩৪৬৫; ফাতাওয়ায়ে শামী ৪/৩৭৯; ফাতাওয়ায়ে মাহমুদিয়া ২৯/৪৮; আহসানুল ফাতাওয়া ১/৪০০)

প্রখ্যাত ফকীহ ব্যক্তিত্ব আল্লামা তাকি উসমানী তার ইসলাহী খুতবাত গ্রন্থে বলেছেন, কেউ যদি চার মাসের কম সময়ের জন্য সফরে বের হয়, তবে তার জন্য স্ত্রীর অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন হবে না। কিন্তু চার মাসের বেশি সময়ের জন্য সফরে বের হলে সফর যত বরকতপূর্ণই হোক না কেন অবশ্যই স্ত্রীর অনুমতি লাগবে। এমনকি যদি হজের সফরও হয় আর তা যদি চার মাসের বেশি সময়ের জন্য হয়, তবে স্ত্রীর অনুমতি প্রয়োজন হবে। দাওয়াত, তাবলিগ ও জিহাদের ক্ষেত্রেও একই বিধান প্রযোজ্য হবে।

ইসলাম স্ত্রীর ওপর স্বামীর অভিভাবকতুল্য কর্তৃত্ব দিয়েছে। তবে স্বামীর ব্যাপারে স্ত্রীর সন্তুষ্টি ও মূল্যায়নকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মুমিন হিসেবে তার ঈমানই সবচেয়ে বেশি পরিপূর্ণ, যার চরিত্র সবচেয়ে ভালো। আর তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই সবচেয়ে চরিত্রবান যে তার স্ত্রীর চোখে চরিত্রবান। ’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ১১৬২)। উল্লিখিত হাদিস থেকে বোঝা যায়, স্বামীর চরিত্র বিচারে স্ত্রীর মূল্যায়ন কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে