চলো বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ি!

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২২; সময়: ৯:২৩ পূর্বাহ্ণ |
চলো বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ি!

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : শহরের কর্মজীবী নারীদের সকাল শুরু হয় অন্যভাবে। সংসারের আনুষঙ্গিক কাজ সেরে বেরিয়ে পড়তে হয় অফিসের উদ্দেশে। অনেক সময় পুরুষরা ধাক্কাধাক্কি করে বাসে উঠতে পারলেও বাস পেতে নারীদের অপেক্ষা করতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

সারিবদ্ধ নারীরা যখন বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকেন, ঠিক একই সময় শাহনাজ পারভীন নিজের স্কুটি চালিয়ে ঝক্কি-ঝামেলা ছাড়াই পৌঁছে যান অফিসে। একটি প্রথম সারির সংবাদমাধ্যমের মেকআপ আর্টিস্ট শাহনাজ পারভীন। তিন বছর ধরে ঢাকার রাস্তায় স্কুটি চালাচ্ছেন।

কেবল শাহনাজ নন, এখন অনেক নারীই চলাচলের ক্ষেত্রে হয়ে উঠেছেন স্বাবলম্বী। বাস যেখানে নারীদের ধাক্কাধাক্কি, যৌন হেনস্তা ও নিরাপত্তাহীনতার একটি ডিপোয় পরিণত হয়েছে, সেখানে বাইক কিংবা স্কুটি এনে দিচ্ছে স্বস্তি ও নিরাপত্তা।

রাস্তায় স্কুটি চালানোর অভিজ্ঞতা নিয়ে শাহনাজ পারভীন বলেন, তিন বছর আগে যখন স্কুটি চালানো শুরু করি, তখন রাস্তায় অনেকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখত। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা বদলে গেছে।

রাস্তায় মেয়েদের স্কুটি চালানোর বিষয়টিতে মানুষ দিন দিন অভ্যস্ত হচ্ছে বলে জানান লেখক ও অ্যাকটিভিস্ট কামরুন্নাহার মুন্নি। তিনি বলেন, ‘আমি ২০১৪ সাল থেকে স্কুটি চালাই। তখন যে পরিস্থিতি ছিল, তা এখন পরিবর্তন হয়েছে। তবে মাঝে একটি দুর্ঘটনা ঘটে। শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের সামনে আমি বছর দেড়েক আগে স্কুটি নিয়ে পড়ে যাই।

স্বাভাবিকভাবেই সালোয়ার-কামিজ পরলে বাতাসে ওড়ে, তাই ঝামেলা এড়াতে স্কুটি চালানোর সময় প্যান্ট ও টপস পরার চেষ্টা করি। যাই হোক, আমি যখন স্কুটি নিয়ে পড়ে গেলাম, তখন আশপাশ থেকে একটা মানুষও সাহায্যের জন্য এগিয়ে এলো না। ট্রাফিক সিগন্যাল পড়ার কারণে হয়তো তেমন ব্যথা পাইনি। কিন্তু সে সময় আমার মনে হয়েছিল, স্কুটি চালাচ্ছি বা আমার মাথায় কাপড় নেই, সেটিই কি আমার অপরাধ কি না।’

মুন্নি বলেন, ‘আমার বাড়িওয়ালা স্কুটি চালানোর বিষয়টি পছন্দ করতেন না। তবে এটি আগের ঘটনা। বর্তমানে মানুষ কিছুটা অভ্যস্ত হয়েছে। কেবল শখের বসে নয়, মেয়েরা পেশাগত সুবিধার জন্যও স্কুটি চালাচ্ছে। যদি ধারাবাহিকভাবে ‍২০১৪ সাল থেকে বলি, তাহলে বলা যায়, এখন পরিস্থিতি অনেকটাই পরিবর্তন হচ্ছে। এখন মানুষ বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে নিতে শিখছে।’

তিনি বলেন, ‘বাঁকা চোখে তাকানোর যে বিষয়টা–সমাজে এত বিষয় আমরা হজম করি যে বাইক চালানো নিয়ে কথা শোনাটা নতুন করে আলাদা কিছু মনে হয় না। আমরা মেয়েরা এতসব বিষয় নিয়ে বাঁকা চাহনির শিকার হই যে বাইক নিয়ে কথা শোনা নতুন কিছু নয়। আর চাহনির ব্যাপারটা কিন্তু শুধু পুরুষের কাছ থেকে আসছে না, অনেক নারীও দেখি পিঠপিছে যা-তা বলেন। আমি শালীন বা অশালীন পোশাক পরছি সেটা না, আন্টিদের সমস্যা আমি বাইক চালাচ্ছি। তবে এখন পরিস্থিতি অনেকটাই ইতিবাচক।’

লাইসেন্স নিতে গিয়ে কী ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়েছে–এমন প্রশ্নের জবাবে শাহনাজ পারভীন বলেন, এ ক্ষেত্রে তেমন সমস্যা হয়নি। সেখানে নারীদের জন্য আলাদা লাইন রয়েছে। তা ছাড়া সেখানের পুরুষদের তুলনায় নারী কম হওয়ায় তেমন ঝামেলায় পড়তে হয়নি। খুব সহজেই লাইসেন্স পাওয়া গেছে।

ঢাকার রাস্তায় নারী হিসেবে বাইক চালানো কতটা কঠিন–এ বিষয়ে কামরুন্নাহার মুন্নি বলেন, ‘আমি ঢাকা ও ঢাকার বাইরে দুই জায়গায়ই বাইক চালিয়েছি। তবে ঢাকায় চালানোর সময় আমার মনে হয়েছে এখানে মানুষ বেশ অসহনশীল, বিশেষ করে সাইড দেয়ার ক্ষেত্রে। গ্রামে স্কুটি চালানোর সময় এমনটা মনে হয়নি।’

ঢাকার রাস্তায় স্কুটি চালানো কঠিন নয়–এমন মন্তব্য করে শাহনাজ পারভীন বলেন, ‘শুরুর দিকে মনে হয়েছে, মেয়েমানুষ হয়ে রাত ১২টায় গাড়ি চালাচ্ছি, আশপাশে আমার মতো কেউ নেই। তখন কিছুটা ভয় লাগত। তবে এখন আমি রাস্তায় স্কুটি চালিয়ে অভ্যস্ত। আমার কোনো কিছু মনে হয় না। রাত ১২টা কি রাত ২টা বা যখন সকালে অফিস থাকে, ভোর ৫টার সময় স্কুটি চালিয়ে আসতে আমার ভয় করে না। অস্বীকার করার উপায় নেই, ঢাকার রাস্তায় স্কুটি চালানো কঠিন। তবে নিজের নিরাপত্তার অনেকটাই নির্ভর করছে আমি কীভাবে স্কুটি চালাচ্ছি তার ওপর।’

পরিবারের উৎসাহেই স্কুটি ও বাইক চালানো শুরু করা–এমন কথা জানান উভয়েই। পরিবারের অনেকেই পাবলিক পরিবহনের তুলনায় স্কুটি চালানোর বিষয়টিকে নিরাপদ মনে করেন।

এ প্রসঙ্গে কামরুন্নাহার মুন্নি বলেন, ‘মায়ের উৎসাহেই প্রথম স্কুটি কিনি। এখনও আত্মীয়রা দুর্ঘটনার বিষয়টি ভয় পান। তবে মেয়ে হয়ে বাইক চালাচ্ছি, এ বিষয় নিয়ে আমি আমার পরিবারের কাছে তেমন কথা শুনিনি। মেয়েদের তো পাবলিক বাসে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এ বিষয়টি এড়াতে আমার পরিবার স্কুটি চালানোই নিরাপদ মনে করে। এমনকি আমি অনেকের কাছেও একই কথা শুনেছি। তারা পাবলিক বাসে ধাক্কাধাক্কি করে চলাফেরা করার থেকে এটিকেই নিরাপদ মনে করেন।’

কয়েক বছর আগেও ঢাকার রাস্তায় কোনো মেয়ে নিঃসংকোচে বাইক বা স্কুটি চালাচ্ছে–এটি একটি অপরিচিত দৃশ্য ছিল। কিন্তু সময় ও নারী স্বাধীনতার পরিপ্রেক্ষিতে বদলে গেছে আগেকার অবস্থান। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক তানিয়া হক সময় সংবাদকে বলেন, ‘মেয়েরা চলাচলের ব্যাপারে আগের থেকে অনেক বেশি স্বাবলম্বী হয়েছে–এটা অবশ্যই একটি ইতিবাচক দিক। একটি মেয়ে যদি লাইসেন্স নিয়ে, ট্রাফিক আইন মেনে, সঠিকভাবে বাইক চালায়, তাহলে কোনো সমস্যা নেই। মেয়েদের এই স্বাধীনতাকে আমি সাধুবাদ জানাই।’

মানুষের পিঠপিছের কথা নিয়ে তানিয়া হক বলেন, মেয়েরা যাই করবে তাতেই কথা শুনবে। একটা মেয়ে চুপচাপ বসে থাকলেও কথা শুনতে হয়, দাঁড়ালেও কথা শুনতে হয়। কথা শোনা মেয়েদের কাছে নতুন কিছু নয়। কিন্তু এসব পাত্তা না দিয়ে, প্রতিকূল পরিস্থিতি ডিঙিয়ে মেয়েদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে।

মানুষের কথা কবে থামবে, মেয়েদের ব্যাপারে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি কবে ভালো হবে–এমন প্রশ্নের উত্তরে তানিয়া বলেন, এটা এক দিনের ব্যাপার নয়। একজন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হলে একদম পরিবার থেকে শুরু করতে হবে। একজন মানুষ শুরু থেকে কীভাবে বেড়ে উঠছে তার ওপর দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারটি অনেক ক্ষেত্রে নির্ভরশীল।

‘স্বাধীনতা তুমি রোদেলা দুপুরে মধ্যপুকুরে গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতার’–নাগরিক কবি শামসুর রাহমানের এই লাইন এসে একাকার হয়ে মিশে যাচ্ছে ঢাকার রাস্তায় অবাধে নিজের স্কুটি কিংবা বাইক নিয়ে ছুটে চলা কোনো মেয়ের সাহসিকতার সঙ্গে। বেগম রোকেয়ার ‘অবরোধবাসিনী’ শব্দটি অভিধানেই আবদ্ধ রেখে মেয়েরা বেরিয়ে আসছে বাইরে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে, যা একটি প্রগতিশীল দেশের জন্য নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে