হামলা-মামলায় আরও কৌশলী বিএনপি

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২২; সময়: ১০:২৩ পূর্বাহ্ণ |
হামলা-মামলায় আরও কৌশলী বিএনপি

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : আবারও বিএনপির ঘাড়ে মামলার ফাঁদ ভর করেছে। জনসম্পৃক্ত চলমান ইস্যুতে দেশজুড়ে মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের ২০ দিনের কর্মসূচিতে প্রায় প্রতিদিনই হামলা-মামলার ঘটনা ঘটেছে। ঝরেছে রক্ত। পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয়েছে ৩ জনের। ৪৯ সাংগঠনিক জেলায় মামলা হয়েছে ৫২টি।

এতে নামে-বেনামে অন্তত বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের ২৯ হাজার নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। কিন্তু এই বৈরী অবস্থার মধ্যেও বিএনপি পালটা কৌশল নিয়ে রাজপথে সক্রিয় থাকতে মরিয়া। একই ইস্যুতে ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ১৬টি সমাবেশের কর্মসূচি পালন করছে দলটি। এরপর আরও কঠোর কর্মসূচি দিয়ে মাঠে নামবে বিএনপি। এমনটিই জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র।

এ প্রসঙ্গে বিএনপির কয়েকজন নীতিনির্ধারক বলেন, সরকার যে এমনটা করবে তা আমরা আগেই বুঝেছি। যেদিন প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে আমাদের গণভবনে চা খাওয়ার দাওয়াত দিয়েছেন এবং পুলিশকে বলেছেন রাজপথে আন্দোলনকারীদের গ্রেফতার না করতে-সেদিনই বুঝে গেছি আসলে কী হতে যাচ্ছে।

তারা বলেন, আগে থেকেই ৩৫ লক্ষাধিক মামলা দিয়ে যেহেতু বিএনপির নেতাকর্মীদের দমানো যায়নি, সেখানে নতুন করে এই গায়েবি মামলার ফাঁদ কোনো কাজে আসবে না। তারা যেখানে মৃত্যুভয়কে পেছনে ফেলে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে মাঠে নেমেছে, সেখানে হামলা-মামলার ভয় নিতান্তই তুচ্ছ। তারা মনে করেন, বিএনপি শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকবেই। সেজন্য সরকার যত কৌশল নিক না কেন, তা কাজে আসবে না।

বিএনপির দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত ২২ আগস্ট থেকে ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশজুড়ে থানা-উপজেলা-পৌর এলাকায় বিএনপির বিক্ষোভ সমাবেশের কর্মসূচি ছিল। এই বিশ দিনে সারা দেশে মোট মামলা হয়েছে ৫২টি। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আওয়াল মিন্টু ও যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনসহ এজাহারভুক্ত আসামি করা হয়েছে সাড়ে ৫ হাজারেরও বেশি নেতাকর্মীকে। অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে প্রায় ২৩ হাজার ১৫০ জনের অধিক।

এছাড়া নিহত হয় ৩ জন। জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য রফিকুল ইসলাম সিকদারসহ সারা দেশে গ্রেফতার ২৮৪ জন। কৃষক দলের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বাবুল, সাবেক সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম মনিসহ সারা দেশে আহত হয়েছেন ২ হাজার ৬৬৮ জন। সারা দেশে ১৪৪ ধারা জারি করা হয় ২৫টি স্থানে। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরীর বাড়ি এবং চেয়ারম্যান আব্দুল আওয়াল মিন্টু ও অ্যাডভোকেট আহম্মেদ আজম খানের গাড়িতে হামলাসহ সারা দেশে নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা হয়েছে অন্তত ৫০টি স্থানে।

জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, নজিরবিহীন বিদ্যুৎ লোডশেডিং, জ্বালানি মূল্যবৃদ্ধি, নিত্যপণ্য মূল্যবৃদ্ধি, গণপরিবহণ ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে দেশের মানুষ যখন আন্দোলন শুরু করেছে, সে সময় তারা (ক্ষমতাসীন দল) আঘাত হানতে শুরু করেছে। আবার সেই আগের মতোই, একই কায়দায়। সেই গায়েবি মামলা, নিজেরা ঘটনা ঘটাচ্ছে, ঘটিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই তারা মিথ্যা মামলা দিয়ে দিচ্ছে। মূলত সারা দেশের তৃণমূলে বিএনপির কর্মসূচিতে মানুষের স্রোত দেখে ভয় পেয়েছে ক্ষমতাসীন দল। তাই মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি শুরু করেছে। এসব করে কোনো কাজ হবে না। আন্দোলন আরও জোরদার করা হবে।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ২২ আগষ্ট থেকে বুধবার (গতকাল) পর্যন্ত মোট মামলা ৭২টি। পুলিশ গুলি চালিয়ে ৩ নেতাকে হত্যা করেছে। নেত্রকোনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, বরগুনা, বরিশাল, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, ঝালকাঠিতে গুলি করে বিএনপি নেতাকর্মীসহ ছাত্রদল, যুবদলের কর্মীদের শরীর ও চোখ-মুখ ঝাঁঝরা করে দিয়েছে। বিভিন্ন হাসপাতালে তারা জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে।

ইতোমধ্যে অনেকে চোখ, হাত ও পা হারিয়েছে। অসংখ্য নেতাকর্মী শরীরে গুলি নিয়ে হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছেন। হামলা-মামলা করে কোনো লাভ হবে না। বরং বিএনপির নেতাকর্মীরা আরও চাঙা হয়েছে। তারা রাজপথে নেমেছে, সরকার পতনের মাধ্যমেই ঘরে ফিরবে। তিনি বলেন, ‘এই সরকারের প্রতি দেশের বেশিরভাগ মানুষ ক্ষুব্ধ। তাই সাধারণ মানুষও বিএনপির কর্মসূচিতে স্বেচ্ছায় শামিল হচ্ছে।’

বিএনপির দপ্তর সূত্রে আরও জানা গেছে, বিশ দিনে ঢাকা, ফরিদপুর, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, খুলনা, লক্ষ্মীপুর, নাটোর, ঠাকুরগাঁও, চট্টগ্রাম উত্তর ও দক্ষিণ, ফেনী, খাগড়াছড়ি, মাগুরা, নরসিংদী, বরিশাল, পিরোজপুরসহ ৪৯ সাংগঠনিক জেলায় মামলা হয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম উত্তর জেলায় সবচেয়ে বেশি ৪টি মামলা হয়েছে।

এ জেলার বিএনপির আহ্বায়ক গোলাম আকবর খন্দকার বলেন, নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। এখন নানাভাবে নেতাকর্মীদের হয়রানি করছে। রাতে পুলিশ বাসায় বাসায় গিয়ে তল্লাশি চালাচ্ছে। নেতাকর্মীরা বাসায় পর্যন্ত থাকতে পারছেন না।

এদিকে মামলার পর উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিতে প্রতিদিন ঢাকায় আসছেন স্থানীয় নেতারা। হাইকোর্ট থেকে গত এক সপ্তাহে অন্তত ৬২২ জন নেতাকর্মী আগাম জামিন নিয়েছেন। সোমবারও কুমিল্লার সাবেক এমপি আব্দুল গফুর ভুঁইয়া, ফেনীর সোনাগাজীর উপজেলা বিএনপির সভাপতি গিয়াস উদ্দিনসহ আরও কয়েকটি জেলার বিএনপির ৪৫২ নেতাকর্মীকে আগাম জামিন দিয়েছেন আদালত।

বিএনপির একাধিক নীতিনির্ধারক জানান, বিএনপি যাতে ফের সংগঠিত হতে না পারে সেজন্য নতুন করে মামলা ও গ্রেফতারের কৌশল নেওয়া হয়েছে। সক্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের টার্গেট করে মামলা এবং গ্রেফতার করা হচ্ছে। নেতারা আগাম জামিন নিতে ঢাকা এলে হোটেল থেকে গ্রেফতারের ঘটনাও ঘটছে।

বিএনপি সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছে। অতীতেও দমন-নিপীড়ন, মামলা-গ্রেফতার করে কোনো আন্দোলনকে দমানো যায়নি, এবারও তা পারবে না। সারা দেশের থানা-উপজেলা-পৌর এলাকায় কর্মসূচি শেষ হয়েছে। ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঢাকা মহানগরে বিক্ষোভ সমাবেশের কর্মসূচি রয়েছে। এরপর আবারও নতুন কর্মসূচি দেওয়া হবে। ধীরে ধীরে কর্মসূচি আরও কঠোর করা হবে।

এদিকে দেশের চলমান সংকট সমাধানে বড় দুই রাজনৈতিক দল-আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে আলোচনায় বসার তাগিদ দিয়েছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা মনে করেন, আন্দোলন কিংবা দমননীতি কোনো সমাধান নয়, রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমেই সংকট উত্তরণের একমাত্র সমাধান।

বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী মনে করেন, আগামী নির্বাচন ক্ষমতাসীন দল তাদের মতো করেই করতে চাইবে। তাই সামনে বিএনপির মিছিল-মিটিং যত বেশি হবে, সরকারও দমননীতি আরও বেশি কঠোর করবে।

তিনি বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশ এখন একটা সংকটের মধ্যে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষ একটা অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়েছে। এ মুহূর্তে জাতীয় এ সংকট থেকে বের হওয়ার জন্য অন্তত বড় দুই দলের মধ্যে একটা আলোচনা হওয়া দরকার। এটার দায়িত্ব সরকারেরই বেশি। দুর্ভাগ্য যে, সরকার সেটা না করে উলটোপথে হাঁটছেন। বিরোধী দলগুলোর নেতাকর্মীদের ওপর দমন-নিপীড়ন চালাচ্ছেন। কিন্তু দমননীতি হলে একটা দেশে যা হয়, সামনে তা-ই হবে।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে