ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের শেষ প্রতীক রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৯, ২০২২; সময়: ২:২৯ অপরাহ্ণ |
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের শেষ প্রতীক রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ

সাঈদ ইফতেখার আহমেদ : ঔপনিবেশিক শাসনের বিস্তারের সাথে সাথে সামন্ত সমাজের প্রতিভূ রাজতন্ত্রের সাথে উঠতি পুঁজিপতি/বণিক শ্রেণির দীর্ঘ দ্বন্দ্বের ফলে অবসান ঘটে নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রের। তবে ঐতিহ্যের প্রতি সম্মান দেখিয়ে প্রতীকী বা সাংবিধানিকভাবে রাজপরিবারকে রেখে দেওয়া হয়।

স্কটল্যান্ডের বালমোরাল প্রাসাদে ৯৬ বছর বয়সে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের জীবনাবসান ঘটেছে বৃহস্পতিবার বিকেলে। ৭০ বছর ধরে তিনি যুক্তরাজ্যের আনুষ্ঠানিক প্রধান ছিলেন। রাজা ষষ্ঠ জর্জের মেয়ে হিসেবে ১৯৫৩ সালে সিংহাসনে অভিষিক্ত হওয়া এলিজাবেথের রাজত্বই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দীর্ঘতম।

১৯৫৩ সালের ২ জুন ২৬ বছর বয়সে রানি হিসেবে অভিষেক হয় দ্বিতীয় এলিজাবেথের। তিনি এমন সময় রানি হন যখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য অস্তমিত হবার পালা শুরু হয়েছে। ১৫৭৮ সালে রানি প্রথম এলিজাবেথের সময় থেকে ইংল্যান্ডের আজকের ব্রিটেনের বাইরে সাম্রাজ্য স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। শুরুতে শুধু আমেরিকা মহাদেশে হলেও পরে তা বিস্তার লাভ করে এশিয়া, আফ্রিকাসহ বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে। এক পর্যায়ে বিশ্বের প্রায় এক পঞ্চমাংশ অঞ্চল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে চলে আসে- যে কারণে বলা হতো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে কখনো সূর্য অস্ত যায় না।

প্রথম এলিজাবেথ ছিলেন প্রবল প্রতাপশালী শাসক। ব্রিটেনে তখন ছিল নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র। রাষ্ট্রের সমস্ত ক্ষমতা তখন রাজপরিবার বিশেষত রাজা বা রানির হাতে। অনেকটা তাদের কথাই ছিল আইন। ব্রিটেনে তখন পুঁজিবাদের সবে বিকাশ শুরু হয়েছে। পুঁজির বিকাশের জন্য প্রয়োজন নতুন নতুন উপনিবেশ।

সামন্ত সমাজ কাঠামোর মধ্য থেকে রাষ্ট্রের উন্নয়ন এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশ, কোনোটাই সম্ভব নয়। এসবের জন্য প্রয়োজন পুঁজিবাদের বিকাশ। আর তা সম্ভব একমাত্র সাম্রাজ্য বিস্তার করে অন্য দেশে উপনিবেশ স্থাপনের মধ্যে দিয়েই-ব্রিটিশ রাজ পরিবার এ বিষয়টা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। তবে যে বিষয়টি তারা ওই সময় উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয় তা হলো, পুঁজিবাদের বিকাশের ফলে রাষ্ট্র ক্ষমতা আর তাদের হাতে থাকবে না।

ঔপনিবেশিক শোষণের মাধ্যমে বিকাশপ্রাপ্ত পুঁজিপতি এবং বণিক শ্রেণি যে এক সময় রাজতন্ত্রের ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে বসবে, এ ধারণা প্রথম দিকে ব্রিটেনসহ ইউরোপের কোনো রাজ পরিবারেরই ছিল না। পুঁজিবাদের বিকাশের সাথে সাথে পুঁজিপতি শ্রেণিরও বিকাশ ঘটে। সামন্ত শ্রেণির হাত থেকে রাষ্ট্র ক্ষমতা তারা তাদের হাতে পেতে চায়। তারা দাবি তোলে, গণতন্ত্র এবং সেক্যুলার রাষ্ট্র কাঠামোর।

তারা বলতে লাগল রাজপরিবার নয়, তারাই জনগণের প্রতিনিধি। ফলে রাজ পরিবারের শাসন করবার কোনো নৈতিক ভিত্তি নেই। সামন্ত সমাজের সহযোগী হিসেবে চার্চকে সমস্ত রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপে নাক গলানো বন্ধ করার দাবিও তোলে তারা। ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে রাজপরিবারের শাসন করবার অধিকার রয়েছে বলে চার্চের যে ফতোয়া রাজতন্ত্রের শাসনের ভিত্তি দিয়েছিল, তা আধুনিক সময়ে অবাস্তব এবং অসঙ্গতিপূর্ণ বলে তারা ঘোষণা করে।

ঔপনিবেশিক শাসনের বিস্তারের সাথে সাথে সামন্ত সমাজের প্রতিভূ রাজতন্ত্রের সাথে উঠতি পুঁজিপতি/বণিক শ্রেণির দীর্ঘ দ্বন্দ্বের ফলে অবসান ঘটে নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রের। তবে ঐতিহ্যের প্রতি সম্মান দেখিয়ে প্রতীকী বা সাংবিধানিকভাবে রাজপরিবারকে রেখে দেওয়া হয়। অর্থাৎ, যে রাজপরিবার এক সময় ছিল প্রবল পরাক্রমশালী, তাদেরকেই তখন থেকে নির্ভর করতে হয় পুঁজিবাদী শ্রেণির দাক্ষিণ্য এবং ইচ্ছের ওপর।

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ছিলেন এ সাংবিধানিক রাজতন্ত্রেরই প্রতিনিধি। তার হাতে কোনো ক্ষমতাই ছিল না। হাউজ অব কমন্সে পাশ হওয়া সিদ্ধান্তে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মতি বা স্বাক্ষর করা ছাড়া কোনো স্বাধীন অবস্থান নেওয়া রানির পক্ষে সম্ভব ছিল না।

বিশ্ব পুঁজিবাদের কেন্দ্রস্থল এখন যেমন যুক্তরাষ্ট্র, একসময় তা ছিল ব্রিটেনে। বিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকেই তা আস্তে আস্তে যুক্তরাষ্ট্রে সরে আসতে শুরু করে ব্রিটেনের পরিবর্তে পুঁজির ব্যাপক বিনিয়োগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হবার কারণে এবং ব্রিটেনের একের পর এক উপনিবেশ হারাবার প্রক্রিয়া শুরু হবার ফলে।

তারপরও ১৯৫৩ সালে যখন রানি হিসেবে দ্বিতীয় এলিজাবেথের অভিষেক ঘটে তখনো ৭০টির বেশি টেরিটরি ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে। তিনি শুধু যুক্তরাজ্যের নন, কমনওয়েলথভুক্ত ছয়টি স্বাধীন রাষ্ট্রের- কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, পাকিস্তান এবং সিলোন (শ্রীলঙ্কা) রানি হিসেবেও অভিষিক্ত হন।

রানির সময়কালে ব্রিটিশ রাজত্বের পরিসীমা অনেক ছোট হয়ে আসে। মৃত্যুর আগে তিনি যুক্তরাজ্যসহ ১৫টি দেশ এবং টেরিটরির প্রধান ছিলেন। শুধু তাই নয় তার জীবদ্দশায় যুক্তরাজ্য নিজেই টিকে থাকবে কিনা, এ প্রশ্নের মুখোমুখিও তাকে হতে হয়। তাকে দেখতে হয় সিন ফেইনের নেতৃত্বে উত্তর আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতা সংগ্রাম। সিন ফেইনের সশস্ত্র শাখা আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির হাতে রানির এক নিকট আত্মীয়কেও প্রাণ দিতে হয়।

জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এলিজাবেথকে দেখতে হয় ব্রেক্সিট থেকে বেরিয়ে যাওয়া এবং রুশ-ইউক্রেইন যুদ্ধের ফলশ্রুতিতে স্মরণাতীতকালের প্রবল অর্থনৈতিক চাপ। এসবের ফলে এমনকি অদূর ভবিষ্যতে ওয়েলস এবং স্কটল্যান্ডও ইংল্যান্ডের সাথে থাকবে কিনা- এ ধরনের কথাবার্তাও তাকে শুনতে হয়।

ব্রিটেনের প্রধান হিসেবে বিশ্ব রাজনীতির অবিশ্বাস্য উত্থান-পতন প্রত্যক্ষ করেন এলিজাবেথ। তার অবস্থানের কারণে এসব কিছুই নীরবে প্রত্যক্ষ করা ছাড়া অন্য কোনো ভূমিকা পালনের অবকাশ ছিল না।

এলিজাবেথ যখন রানি হন, তার কয়েক বছর পূর্বেই মাও সে তুংয়ের নেতৃত্বে চীনে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটে গেছে। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলি তখন সোভিয়েত বলয়ের অন্তর্গত। পশ্চিমা দুনিয়াতেও তখন অনেকে ধরে নিয়েছিলেন মানব জাতির ভবিষ্যত হয়ত সমাজতন্ত্রের দিকেই। সমাজতন্ত্রের ধাক্কা পশ্চিম ইউরোপে লাগবে কিনা- এ প্রশ্নে তখন অনেকে আতঙ্কিত।

বাম ধারা শক্তিশালী হয়ে উঠছিল পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলিতেও। সোভিয়েত ইউনিয়নকে মনে করা হচ্ছিল অজেয় শক্তি। সেই অজেয় শক্তি রানি এলিজাবেথের রাজত্বকালেই তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়ে। আবার ব্রিটেন, আমেরিকাসহ পশ্চিমা দুনিয়া যেখানে ধরে নিয়েছিল রুশ সাম্রাজ্যের পতন চিরতরে ঘটে গেছে- পুতিনের হাত ধরে ওই রুশ সাম্রাজ্যের উত্থানও রানির রাজত্বকালেই ঘটে। উল্লেখ্য, ঐতিহাসিকভাবে রাশিয়ার সাথে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বন্দ্ব রয়েছে। ফলে রাশিয়ার উত্থান ব্রিটেনকে আবার নতুন করে অস্বস্তিতে ফেলেছে।

রানি এলিজাবেথের শাসনামলে বিশ্বে এমন সব অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটেছে যার ফলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মাঝে এ প্রতীতি জন্মেছে যে, রাজনীতিতে পরম স্থায়ী বলে কিছু নেই। এক সময় যেমন মনে করা হতো সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি অজেয় রাষ্ট্র- কখনোই তার পতন ঘটবে না; তেমনি মনে করা হয় যুক্তরাজ্যের সাংবিধানিক রাজতন্ত্রও চিরস্থায়ী।

এ বিশ্বাস থেকে মিশরের ক্ষমতাচ্যুত রাজা ফারুক বলেছিলেন দুনিয়াতে শুধু পাঁচ রাজা টিকে থাকবে- তাসের চার রাজা আর ব্রিটেনের রাজা। ওই ব্রিটেনের নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের আদৌ প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা, রাজপরিবারের পেছনে এত বিপুল অর্থব্যয় জনগণের অর্থের অপচয় কিনা- এসব প্রশ্নও বারবার উঠে এসেছে রানির জীবদ্দশায়। আজকে যিনি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী, সেই লিজ ট্রাসও ছাত্রজীবনে সোচ্চার ছিলেন রাজতন্ত্রের চির অবসানের পক্ষে।

সামন্ততন্ত্রকে হটিয়ে পুঁজিবাদী শ্রেণি ক্ষমতাসীন হলেও তারা সামন্ততান্ত্রিক রীতি, নীতি, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সাথে ব্যাপক সমঝোতা করে বা শ্রদ্ধা জানিয়ে দেশ পরিচালনা করে আসছে। ফলে ব্রিটিশ জনগণ আজও নাগরিক না হয়ে প্রজা। তেমনি উপনিবেশের যে বিস্তার পুঁজিবাদী শ্রেণির হাত ধরে ঘটেছে, ওই বিস্তারে প্রতীকী অর্থে তাদের নেতৃত্বে থেকেছেন সামন্ততন্ত্রের প্রতিভূ রাজা বা রানি।

সামন্ততান্ত্রিক ব্রিটেনের উত্তরাধিকার রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথও ছিলেন পুঁজিবাদী ব্রিটেনের প্রতীকী নেতা। তার সময়কালেই প্রায় সমস্ত উপনিবেশ হারিয়ে রাষ্ট্র হিসেবে আগামী দিনগুলিতে খোদ ব্রিটেন নিজেই টিকে থাকবে কিনা এ প্রশ্ন উঠেছে। তবে রাষ্ট্র হিসেবে ব্রিটেন বা রাজতন্ত্রের ভবিষ্যত যাই হোক না কেন, ইতিহাসে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের আসন থেকে যাবে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ব্রিটিশ শাসক হিসেবে। সূত্র- বিডিনিউজ

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে