বিনামূল্যের গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষে ব্যস্ত চাষিরা

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৫, ২০২২; সময়: ৭:৪৩ অপরাহ্ণ |
বিনামূল্যের গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষে ব্যস্ত চাষিরা

নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজশাহী অঞ্চলে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষে কৃষকের আগ্রহ বাড়ছে। এই পেঁয়াজ চাষ করে ভালো ফলন পাচ্ছেন কৃষকরা। দেশে পেঁয়াজ নিয়ে সংকটে ঘাটতি মেটাতে ভাল ফল পাওয়া যাবে। তাই কৃষি বিভাগ স্বল্প খরচে যেন অধিক পরিমাণ পেঁয়াজ উৎপাদন করা যায় সেদিকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিচ্ছেন।

নানা দুর্যোগ ও প্রতিকুল আবহাওয়ার মধ্যেও দেশে পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করেছে এই গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ। আগাম এই পেঁয়াজ চাষে কৃষককে সহযোগিতা, প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন কৃষি বিভাগ। এখন রোপনকৃত পেঁয়াজ নভেম্বর মাস থেকেই তোলা যাবে। আবাদের এ নতুন ধারায় একদিকে দেশের পেঁয়াজ সংকট দূর হবে এবং অন্যদিকে আর্থিকভাবে লাভবান কৃষকেরা।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, আমাদের দেশে প্রচলিত মৌসুম অনুযায়ী ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে সাধারণত চাষিরা পেঁয়াজের চারা রোপণ করে থাকেন। তখন চাষি আশানুরুপ ফলন পেলেও দাম কম পেয়ে থাকে। এজন্য খরিপ-২ এ অসময়ে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের চারা উৎপাদন করে বাজার অস্থিরতা রোধকল্পে এবং চাষিদের লাভবান করার লক্ষ্যে বিনামূল্যে বিতরণ চারা করা হচ্ছে। এতে গ্রীষ্মকালিন পেঁয়াজ চাষে লাভবান হওয়ার লক্ষ্যে পেঁয়াজ চাষে আগ্রহ বেড়েছে চাষিদের।

গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের নমুনা হার্ভেস্টে দেখা যায়, বারি-৫ জাতের গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের উৎপাদন হেক্টর প্রতি প্রায় ১৯ মেট্রিক টন। রাজশাহী জেলায় এবার ২৬৬ হেক্টর জমিতে নতুন পদ্ধতিতে বারি পেঁয়াজ-৫ সহ বিভিন্ন জাতের পেঁয়াজ আবাদ করা হয়েছে। এ বছর রাজশাহী জেলায় ১৭৯ জন কৃষক প্রায় ২৬৬ হেক্টর জমিতে বারি-৫ জাতের গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের চাষ করেছেন।

সরেজমিনে পবা উপজেলার উজিড়পুকুর, মাড়িয়া, পান্থাপাড়া এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এই এলাকার কৃষকরা গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষে ব্যস্ত সময় পার করছেন।

জেলার পবা উপজেলার উজিড়পুকুর গ্রামের কৃষক নাজির উদ্দিন বলেন, পবা উপজেলায় শীতকালে ব্যাপক পেঁয়াজ চাষ হয়। তবে সময়, চাহিদা ও দাম না পাওয়ায় চাষিকে ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। গত বছর তিনি গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষ করে ভালো ফলন ও ভালো দাম পেয়েছেন। তাই তিনি এবার ১০ বিঘা জমিতে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষে করেছেন। ওই জমিতেই পরে আবার শীতকালীন পেঁয়াজের চাষ করবে বলে জানান তিনি।

পবা উপজেলার মাড়িয়া গ্রামের কৃষক আলমগীর হোসেন জানান, তিনি ৫ বিঘা বারি পেঁয়াজ-৫ চাষ করেছেন। আবহাওয়া অনুকূল হওয়ায় এ পেঁয়াজ চাষে ঝুঁকি কম। নভেম্বর থেকেই এ পেঁয়াজ তোলা যায় বলে তিনি জানান। ফলে সারা বছর পেঁয়াজ চাষ ও সংরক্ষণ করা সম্ভব বলে জানান তিনি।

পবা উপজেলার পান্থাপাড়া গ্রামের পেঁয়াজ চাষি নজরুল ইসলাম জানান, ১৫ বিঘা জমিতে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষ করেছেন। ৯৫ থেকে ১১০ দিনে বিঘায় ১২০ থেকে ১৫০ মণ উৎপাদন হয়। গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষে প্রতি বিঘায় ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়।

পবা উপজেলা অতিরিক্ত কৃষি কর্মকর্তা মরিয়ম আহমেদ বলেন, সারা দেশব্যাপি চলতি খরিপ মৌসুমে (২০২২-২৩) গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের আবাদ বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশের প্রান্তিক চাষিদের মাঝে “কৃষি প্রণোদনা ও পুনর্বাসন কর্মসূচীর” আওতায় বিনামূল্যে বীজ, সার ও অন্যান্য উপকরণ বিতরণ করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় পবা উপজেলায় ২৭০ জন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের মাঝে বিনামূল্যে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের বীজ, সার ও অন্যান্য উপকরণ বিতরণ করা হয়। প্রণোদনার নীতিমালা মোতাবেক একজন কৃষক এক বিঘা জমির জন্য এক কেজি পেঁয়াজের বীজ, ২০ কেজি ডিএপি সার ও ২০ কেজি এমওপি সার এবং চারা উৎপাদন খরচ বাবদ বিঘা প্রতি ২ হাজার ৮শ’ টাকা সহায়তা হিসেবে পান।

এ বিষয়ে পবার উপজেলা কৃষি অফিসার শফিকুল ইসলাম বলেন, সাধারণত অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বরের দিকে পেঁয়াজের বেশি ঘাটতি হয়। এই সময়ের মধ্যে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ উৎপাদন হলে দেশে পেঁয়াজের ঘাটতি আর থাকবে না। পাশাপাশি এই পেঁয়াজের আবাদের সফলতা পেলে তা পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়বে। এ জাতের (এন-৫৩) পাঁচ থেকে ছয়টা পেঁয়াজেই এক কেজি ওজন হয়। তাই এই পেঁয়াজ চাষে সাধারণ ক্রেতা থেকে শুরু করে প্রান্তিক কৃষকও লাভবান হবেন। সারাদেশে এই পেঁয়াজের চাষাবাদ হলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই দেশে পেঁয়াজের বিদ্যমান ঘাটতি পূরণ করে বিদেশেও রফতানি করা সম্ভব হবে।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মোজদার হোসেন জানান, জেলায় বিভিন্ন চাষির মাধ্যমে ২৬৬ হেক্টর জমিতে বারি পেঁয়াজ-৫ আবাদ করা হয়েছে। নতুন পদ্ধতিতে পেঁয়াজ উৎপাদনে রাজশাহী জেলার কৃষিতে যুগান্তকারী পরিবর্তনের এক নতুন মাইলফলক স্পর্শ করেছে। লাভ ও ফলনে কৃষকদের মাঝে ব্যাপক আগ্রহ বেড়েছে।

তিনি বলেন, গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষকে সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে কৃষি মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে কৃষকদের প্রণোদনাসহ করণীয় নির্ধারণ করে ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। সেই লক্ষ্যে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষ প্রকল্পের আওতায় জেলায় দুই হাজার কৃষককে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষ বিষয়ক কারিগরি প্রশিক্ষণ ও বিনামূল্যে বীজ দেওয়া হয়েছে। আবহাওয়া অনূকল হওয়ায় এ পেঁয়াজ চাষে ঝুঁকি কম। নভেম্বর-ডিসেম্বর এবং জানুয়ারির মাঝামাঝি ক্ষেত থেকে এ পেঁয়াজ ওঠানো যায়।

পবা কৃষি অফিস থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশের মাটি ও আবহাওয়া পেঁয়াজ চাষের এবং পেঁয়াজ বীজ উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত ভাল। আধুনিক পদ্ধতিতে পেঁয়াজ চাষ করে ফলন ও মোট উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায়। আর এর মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ করা যায় এবং বাড়তি আয়, কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়। আমাদের দেশে প্রায় সকল মসলা ফসলের চাহিদা দেশে উৎপাদনের চেয়ে অনেক বেশি। পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হলে মৌসুম ভিত্তিক পেঁয়াজের পাশাপাশি গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ উৎপাদনে তৎপর হতে হবে।

পেঁয়াজের চাষ করতে সব রকম মাটি ব্যবহার হলেও সেচ ও পানি নিষ্কাশনের সুবিধাযুক্ত বেলে দোঁ-আশ বা পলিযুক্ত মাটি পেঁয়াজ চাষের জন্য খুব ভালো। প্রচুর দিনের আলো, সহনশীল তাপমাত্রা ও মাটিতে প্রয়োজনীয় রস থাকলে পেঁয়াজের ফলন খুব ভালো হয়। হেক্টরে ৪-৫ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়। অর্থাৎ প্রায় ৬০০-৭০০ গ্রাম বীজ প্রতি বিঘার জন্য প্রয়োজন হয়। খরিফ মৌসুমে উৎপাদনের জন্য চারা তৈরি করে মাঠে রোপণ করাই উত্তম। রোপণের ৩-৪ সপ্তাহ পূর্বে হালকা গভীর অর্থাৎ ১৫-২০ সেন্টিমিটার করে ৪-৫ টি চাষ ও মই দিতে হবে। পেঁয়াজের শিকড় মাটিতে ৫-৭ সেন্টিমিটারের মধ্যে বেশি থাকে। উৎপন্ন চারা জমিতে রোপণ করলে কন্দ বড় হয় এবং ফলন বেশি হয়।

পেঁয়াজের জন্য তৈরি জমিতে মাঝে মাঝে নালা রেখে ছোট ছোট বেডে ভাগ করা হয়। বেডগুলো ১ মিটার চওড়া এবং ৬ ইঞ্চি উঁচু করে তৈরি করতে হবে। বেডে ৩৫-৪০ দিন বয়সের সুস্থ চারা, ১০-১৫ সেন্টিমিটার (সারি-সারি) দূরত্বে ও ৮-১০ সেন্টিমিটার (চারা-চারা) দূরে এবং ৩-৪ সেন্টিমিটার গভীর গর্তে ১টি করে রোপণ করতে হবে। কন্দ গঠন শুরু হওয়া চারা রোপণ করা যাবে না এবং চারা রোপণের পর সেচ দিতে হবে।

মাটিতে প্রয়োজনীয় পরিমাণ জৈব ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করে চাষ করলে পেঁয়াজ বেশ বড় ও ভারী হয় এবং অনেকদিন সংরক্ষণ করা যায়। ভালোভাবে সেচ ও সার প্রয়োগের মাধ্যমে চাষ করলে জাত ভেদে হেক্টরপ্রতি ১৩-২০ টন ফলন পাওয়া যায়। সরাসরি বীজ বপন করে চাষ করার চেয়ে পেঁয়াজের চারা রোপণ করলে ২০-২৫ শতাংশ ফলন বেশি হয়।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে