প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফরের রাজনৈতিক তাৎপর্য

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৪, ২০২২; সময়: ৯:৫০ অপরাহ্ণ |
প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফরের রাজনৈতিক তাৎপর্য

এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন : অতিমারি কভিড-১৯ পৃথিবী নামের গ্রহকে স্বস্তিতে রাখেনি। যার প্রভাবে অর্থনৈতিকভাবে অতিসচ্ছল দেশগুলোও বিপদে পড়েছে। উপরন্তু, রাশিয়া-ইউক্রেন রণ সমাচার বৈশ্বিক জায়গা থেকে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়েই ধরা দিয়েছে। ঠিক এমন এক প্রেক্ষাপটের ওপর দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা দিল্লি যাচ্ছেন। স্বভাবতই এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক ঝালিয়ে নেওয়ার মাহেন্দ্রক্ষণের সৃষ্টি হয়েছে।

দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার যে ৫১ বছরের সম্পর্ক, তা নিছক পররাষ্ট্রনীতির আওতায় থেকে চুক্তিনির্ভর স্বার্থপরতায় গণ্ডিবদ্ধ নয়। পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক শাসনের নিষ্পেষণে পূর্ববাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যখন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে, তখন ভারত সরকার যে সহায়তা করেছিল, তা বাংলার মানুষ কখনও ভুলবে না।

প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয়, মুক্তিযোদ্ধাদের সামরিক সহায়তা দেওয়াসহ ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যে ভূমিকা রেখেছিলেন, তা বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনকে ত্বরান্বিত করেছিল। বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশ থেকে খুব অল্প সময়ের মধ্যে ভারতীয় মিত্রবাহিনীকে ফেরত নিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে ইন্দিরা গান্ধী যে সদিচ্ছা দেখিয়েছিলেন, তা ইতিহাস সৃষ্টি করে।

ভারত ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। ভারতে সরকার পরিবর্তন হলেও তাদের আন্তর্জাতিক নীতির পরিবর্তন হয় না। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ব্যতীত অন্য কোনো দল সরকার গঠন করলে তাদের নীতি ও কর্মসূচিতে ভারতবিরোধী অবস্থানই শুধু প্রকাশ পায় না; ভারতের বিপক্ষে জনমত গঠনেও তারা তৎপর হয়। সংগত কারণে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি প্রশ্নে সরকার পরিবর্তন হলে আর তা এক লক্ষ্যে বা সমমনা সিদ্ধান্তে থাকে না।

আমরা দেখেছি, ২০০১ সালের নির্বাচনের পর মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধশক্তিকে সঙ্গে করে যে কথিত জাতীয়তাবাদী শক্তি চারদলীয় জোট করে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছিল; তখন তারা ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে শুরু করেছিল। গত তিন মেয়াদে শেখ হাসিনার সরকার তা পরিহার করে এমন নীতি গ্রহণ করেছে, যাতে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদ ও নিরাপত্তাহীনতা উস্কে দিতে বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহূত না হয়।

সম্প্রতি ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং একটি যুদ্ধজাহাজের উদ্বোধনকালে তাই বলেন- ‘বাংলাদেশের চেতনা ও আদর্শিক অবস্থানকে শ্রদ্ধা করতে হবে।’ তিনি প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক সুসম্পর্কের পাশাপাশি সামরিক ক্ষেত্রকেও গুরুত্ব দিয়ে বলেন, ‘প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে দিল্লির সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ সরকার ধর্মীয় হিংসার উন্মাদনা ও কট্টরপন্থিদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। যেভাবে বাংলাদেশ উন্নতির দিকে ধাবিত হচ্ছে, প্রতিবেশী দেশ হিসেবে আমরা উচ্ছ্বসিত।’

আমি মনে করি, এই পরিস্থিতি অব্যাহত রাখতে হলে উভয় দেশেই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা জরুরি। আর রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা প্রতিরোধে বাংলাদেশে মৌলবাদী রাজনীতির অনুপ্রবেশকে পাত্তা দেওয়া যাবে না। একই সঙ্গে ভারতের রাজনৈতিক শৃঙ্খলার ধারাবাহিকতা রাখতে বাংলাদেশের শাসনক্ষমতায় এমন কোনো রাজনৈতিক শক্তিকে সমর্থন দেওয়া যাবে না, যারা ভারতের সঙ্গে আপাতভাবে অভিনয়শৈলী দেখিয়ে স্বার্থ সংরক্ষণ করবে।

এদিকে আসন্ন শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় যৌথ নদী কমিশন বৈঠকের বৃত্তান্ত নিয়ে অভিন্ন নদীগুলোর পানি বণ্টন বিষয়ে আলাপ হবে বলে আশা করা যায়। এবার কুশিয়ারার পানি বণ্টন নিয়ে একটি চুক্তি হতে পারে বলে অনুমিত হয়, যদিও তিস্তা চুক্তির সুফল বাংলাদেশ পেতে চায়। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটানকে নিয়ে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের নেতৃত্বে রয়েছে ভারত। বাংলাদেশ নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আনতে চায়। একই সঙ্গে এ অঞ্চলে জ্বালানি নিরাপত্তা কানেক্টিভিটি নিয়ে যৌথভাবে কাজ করতে চায় বাংলাদেশ।

আমরা জানি, ২০১৫ সালের জুনে ভারত-বাংলাদেশের সীমান্ত চুক্তির মাধ্যমে ভারতের ১১১টি ছিটমহল এবং বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল বিনিময় হয়। এতে নাগরিকত্বহীন ৫০ হাজারের বেশি মানুষ তাদের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত নাগরিকত্ব লাভ করে। দুই দেশ তাদের সীমান্তবর্তী চোরাচালান সমস্যার সমাধানে এবং সৌহার্দ্য বাড়াতে সীমান্ত হাটের ব্যবস্থা করে। ২০২২ সালের এপ্রিলের হিসাব অনুযায়ী, সাতটি সীমান্ত হাট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং আরও ৯টি উদ্বোধনের অপেক্ষায়।

ইতিহাস বলছে, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রথম বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল ১৯৭২ সালে। ২০১৫ সালে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা নবায়ন হয়। বাংলাদেশের স্থিতিশীল অর্থনৈতিক উন্নয়ন ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করছে। গত এক দশকে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি তিন গুণ হয়ে ২০১৮-১৯ সালে ১ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে।

২০১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশে ভারতীয় রপ্তানি ছিল ৮ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার এবং আমদানি ১ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলার। প্রকাশিত তথ্যানুসারে, ২০২১-২২ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও চীনকে পেছনে ফেলে ভারতের চতুর্থ বৃহত্তম রপ্তানি গন্তব্য হয়েছে বাংলাদেশ। শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি এই ইস্যুতেও তাঁদের আলোচনাকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে। বিশ্বরাজনীতির নতুন নতুন সমীকরণ হচ্ছে, হতেই থাকবে।

বাংলাদেশ ও ভারত শুধু ভৌগোলিক পর্যায়ে সীমান্ত সম্পর্কেই আবদ্ধ নয়। সামাজিক নিরাপত্তা, অর্থনীতি, শিল্প, সাহিত্য, রাজনীতি, যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ নানা ক্ষেত্রে পরস্পর নির্ভরশীল। ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কের বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনা তখনই স্পষ্ট হয়, যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে নেতৃত্ব দেওয়া দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকে।

বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলা করার জন্য দুই রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি একটি অর্থবহ বৈঠক করার মধ্য দিয়ে দুই দেশের মিত্র সম্পর্ককে আরও মজবুত করবেন বলে বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বাস করে। বাংলাদেশ-ভারতের দ্বিপক্ষীয় সুসম্পর্ক আঞ্চলিক পর্যায়ের গণ্ডি পেরিয়ে বৈশ্বিক শান্তি ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রকে আরও সুদৃঢ় করে একটি সমৃদ্ধ অঞ্চল গড়ে তুলবে। শেখ হাসিনার দিল্লি সফর সফল হোক।

লেখক- এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন. সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং মেয়র, রাজশাহী সিটি করপোরেশন।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে