পাবনার কলেজ শিক্ষক ৫ বছর ভারতে থেকেও পাচ্ছেন বেতন

প্রকাশিত: আগস্ট ২৮, ২০২২; সময়: ৪:৫৮ অপরাহ্ণ |
পাবনার কলেজ শিক্ষক ৫ বছর ভারতে থেকেও পাচ্ছেন বেতন

রাজিউর রহমান রুমী, পাবনা : পাবনায় এক কলেজ শিক্ষক পাঁচ বছর কলেজে উপস্থিত না থেকেও কলেজ থেকে প্রতি মাসে বেতন (সরকারী অংশ সহ) ভাতা পাচ্ছেন। সে পাবনার মাশুন্দিয়া-ভবানীপুর কে.জে.বি ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক বিশ্বনাথ দত্ত।

তিনি পাঁচ বছর আগে চিকিৎসার নাম করে ভারতে চলে যান। সেখানেই স্ব-পরিবারে বসবাস করছেন। এর আগে বছরে দুই একবার অসলেও গত এক বছর ধরে অনুমতি ছাড়া কলেজে অনুপস্থিত বিশ্বনাথ দত্ত। তাকে চেনেন না কলেজের নবাগত শিক্ষার্থীরা।

অভিযোগ রয়েছে, শিক্ষক বিশ্বনাথ দত্তের এই অপকর্মে কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আব্দুস ছালাম বিশ্বাস ও দেশে থাকা বিশ্বনাথ দত্তের ভাই সুনীল দত্ত পরস্পর যোগসাজশে নিয়মিত বেতন-ভাতা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করে যাচ্ছেন। এছাড়া কলেজ পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি সবকিছু জেনেও অজ্ঞাত কারনে নিশ্চুপ রয়েছেন, কোনো ব্যবস্থা নেননি তিনি।

এসব অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও দুদক বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ওই কলেজের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের সহকারি অধ্যাপক আব্দুল মন্নাফ সরকার। ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন।

এদিকে, অভিযোগের ভিত্তিতে সম্প্রতি কলেজে অভিযান চালিয়ে প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এনফোর্সমেন্ট টিম।

লিখিত অভিযোগ সুত্রে জানা গেছে, পাবনার বেড়া উপজেলার মাশুন্দিয়া-ভবানীপুর কে.জে.বি ডিগ্রি কলেজের গণিত বিষয়ের সহকারী অধ্যাপক বিশ্বনাথ দত্ত চাকুরীতে যোগ দেন ১৯৮৮ সালে। আর এমপিওভুক্ত হন ১৯৯৩ সালে। অভিযোগ, তিনি পাঁচ বছর আগে স্ব-পরিবারের ভারতের কলকাতায় চলে যান এবং সেখানেই বসবাস করছেন। অসুস্থ্য হওয়ায় চিকিৎসার নামে কলেজে দীর্ঘদিন ধরে অনুপস্থিত তিনি। মাঝে মধ্যে দেশে এসে কলেজের কাগজপত্রে স্বাক্ষর করে আবার চলে যান ভারতে।

তবে, এর মাঝে গত প্রায় এক বছর ধরে তিনি বিনা ছুটিতে অবস্থান করছেন সেখানে। অথচ কলেজ থেকে প্রতি মাসের বেতন-ভাতাসহ সকল সুবিধা ভোগ করছেন তিনি। কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আব্দুস সালাম ও কলেজ পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি আব্দুল আজিজ খানের যোগসাজসে এমন অনিয়ম চলছে। প্রশ্ন উঠেছে, ‘কলেজের অধ্যক্ষ এবং পরিচালনা পর্ষদের সভাপতির স্বাক্ষর ছাড়া তো বেতন হয় না। তাহলে এতোদিন বিশ্বনাথ দত্তের বেতন হচ্ছে কিভাবে?

কলেজের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের সহকারি অধ্যাপক আব্দুল মন্নাফ সরকার বলেন, কলেজ অধ্যক্ষের সহযোগিতা ছাড়া বিশ্বনাথ দত্তের এমন জালিয়াতি একার পক্ষে সম্ভব নয়। বিষয়টি বিভিন্ন সভায় জানানো হলেও কেউ কোনো ব্যবস্থা নেননি। এছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালার তোয়াক্কা না করে কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আব্দুস সালাম অনিয়মতান্ত্রিকভাবে টানা তিন বছর ধরে দায়িত্বে রয়েছেন। এসব অনিয়ম দুর্নীতি তদন্তের জন্য বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেছেন বলে জানান সহকারি অধ্যাপক আব্দুল মন্নাফ সরকার।

এদিকে, প্রতি মাসে বেতন-ভাতার টাকা শিক্ষক বিশ্বনাথ দত্তের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হচ্ছে বলে নিশ্চিত করেছেন সোনালী ব্যাংক বেড়া শাখার প্রধান কর্মকর্তা শমিত সরকার। তিনি এর বেশিকিছু জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
ইতিমধ্যে অনিয়মের জালিয়াতির বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসায় নিজেকে বাঁচাতে কলেজের সকল কাগজপত্র, রেজুলেশন, ও বিশ্বনাথ দত্তের ছুটির আবেদন প্রস্তুত করে রেখেছের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। তার মধ্যেও দেখা গেছে অনেক অসঙ্গতি।

অভিযোগের বিষয়ে কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আব্দুস সালাম বলেন, বিশ্বনাথ দত্ত প্রথম করোনা শুরুর সময় অসুস্থ্য হয়ে পড়েন। তিনি চিকিৎসার জন্য ভারতে যেতে ছুটির আবেদন করেন। কলেজের পরিচলনা পর্ষদ তাকে ছুটি দেন। পরে দ্বিতীয় করোনাতেও তিনি অসুস্থ্য হয়ে আবারও ছুটির আবেদন করেন। পরে মানবিক দিক বিবেচনা করে স্ববেতনে তার ছুটি মঞ্জুর করেন পরিচালনা পর্ষদ। তিনি ভারতে চিকিৎসার জন্য যান, ওষুধপত্র নিয়ে আবার আসেন। এভাবেই চলছে। এখানে তার কোনো দায় নেই বলে জানান।

এ ব্যাপারে কলেজ পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি আব্দুল আজিজ খান মুঠোফোনে বলেন, তিনি কলেজের নতুন সভাপতি হয়েছেন। বিশ্বনাথে দত্ত অসুস্থতাজনিত কারণে ছুটি নিয়ে ভারতে থাকেন বলে শুনেছেন তিনি। কলেজে তিন চারটি মিটিং করা হয়েছে। তবে তার সাথে আমার একবারও দেখা হয়নি।

তার স্বাক্ষরে বেতন হয়, তাহলে জানেন না কেন জানতে চাইলে বলেন, অধ্যক্ষ তাকে ভুল বুঝিয়ে স্বাক্ষর নিতে পারেন। হয়তো সেটা খেয়াল করা হয়নি। বিশ্বনাথ দত্তকে কলেজে উপস্থিত হতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তিনি দেশে আসার পর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

বেড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সবুর আলী বলেন, অভিযোগ খতিয়ে দেখতে গত ৮ আগস্ট উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা খবির উদ্দিনকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে আগামী সাত কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। তাদের প্রতিবেদন পাবার পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

অভিযুক্ত শিক্ষক বিশ্বনাথ দত্ত ভারতে অবস্থান করায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশে থাকাকালে তার একটি মোবাইল নাম্বারে ফোন দেয়া হলে সেটিও বন্ধ পাওয়া গেছে। দেশে থাকা তার ভাই সুনীল দত্তের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাকেও পাওয়া যায়নি।

এদিকে, বিষয়টি খতিয়ে দেখতে গত রোববার (১৪ আগস্ট) কলেজে অভিযান চালিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এনফোর্সমেন্ট টিম। এ সময় অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে টিম। দুদকের উপ-পরিচালক (জনসংযোগ) মুহাম্মদ আরিফ সাদেক অভিযানের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

তিনি বলেন, পাবনা সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ-সহকারী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান, মনোয়ার হোসেন, ফেরদৌস রায়হান বকসী ও মোক্তার হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত এনফোর্সমেন্ট টিম সরেজমিনে অভিযান পরিচালনা করেন। অভিযানকালে কলেজটিতে রক্ষিত বিভিন্ন রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা এবং অভিযোগ সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করা হয়।

প্রাথমিকভাবে অভিযোগের বিষয়টি এনফোর্সমেন্ট টিমের কাছে সত্য বলে প্রতীয়মান হয়েছে। রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশসহ বিস্তারিত প্রতিবেদন শিগগিরই কমিশনে এনফোর্সমেন্ট টিম দাখিল করবে বলে জানান আরিফ সাদেক।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে