নাটোরে সারের সংকট ও দামে দিশেহারা কৃষক

প্রকাশিত: আগস্ট ২৩, ২০২২; সময়: ১২:১১ অপরাহ্ণ |
নাটোরে সারের সংকট ও দামে দিশেহারা কৃষক

নিজস্ব প্রতিবেদক, নাটোর :  সার সংকট ও দাম বেশী নেওয়ায় নাটোরের কৃষকরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। খাদ্য উদ্বৃত্ত জেলা নাটোরে বর্তমানে পটাশ সার মিলছেনা। অপরদিকে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের হুঁশিয়ারী সত্বেও ঠেকানো যাচ্ছেনা সারের অবৈধ মুজুদ।

অবশ্য প্রতিমন্ত্রী পলকের ঘোষনার ২৪ ঘন্টা পার না হতেই সোমবার পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসন সিংড়া উপজেলার শালমারা গ্রাম থেকে অবৈধ মজুদ করা ৩৬৮ বস্তা সার উদ্ধার করে ৪৮ ঘন্টার মধ্যে বিতরণের নির্দেশ দিয়েছে উপজেলা প্রশাসন।

এর আগে রোববার উপজেলা প্রশাসনের একটি সভায় সার মজুদদারের বিরুদ্ধে কঠোর হুশিয়ারী দেন প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এমপি। প্রতিমন্ত্রী পলকের ওই হুঁশিয়ারীর পরদিন ভ্রাম্যমান আদালত সিংড়া উপজেলার ইটালী ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি সদস্য ও ৫ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মোকলেছুর রহমানের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে অবৈধভাবে মজুদ ৩৬৮ বস্তা ইউরিয়া সার জব্দ করে।

পরে লাইসেন্স না থাকায় এবং অবৈধভাবে মজুদ রাখার অপরাধে সার ব্যবস্থাপনা আইন ২০০৬ অনুযায়ী আওয়ামীলীগ নেতা ও ইউপি সদস্য মকলেছুর রহমানকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমান আদালতের নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট ও সহকারী কমিশনার ভূমি আল ইমরান। একই সাথে আগামী ২ দিনের মধ্যে কৃষি কর্মকর্তার তদারকিতে ন্যায্যমূল্যে কৃষকদের মাঝে সার বিক্রির নির্দেশ দেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।

তবে ইউ পি সদস্য মোকলেছুর রহমান নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে তিনি শালমারা বাজারে খুচরা সার বিক্রি করেন। সার বিক্রি করার জন্য ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে একটি লাইসেন্সের জন্যও আবেদন করা আছে।

সংশ্লিষ্ট সুত্র জানা জায়, চলতি মাসে বরাদ্দকৃত পটাশ সার সরবরাহ করা হলেও তা চাহিদা অনুযায়ী নয়। এছাড়া আগামী মাসের জন্য পটাশ সার মজুদ নেই। ফলে মজুদদারদের কাছে থেকে চাষীদের দ্বিগুন দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে। জেলা ফাইটিলাইজার সমিতি পটাশ সার বরাদ্দের জন্য জেলা প্রশাসক ও জেলা কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের বরাবরে আবেদন জানিয়েছে।

অপরদিকে জেলা কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর সুত্রে জানাযায়, নাটোর জেলায় চলতি মাসে ৫৬১২ মেট্রিক টন ইউরিয়া সারের চাহিদার বিপরীতে বরাদ্দ পাওয়া গেছে ৩৫৮৭ মেঃটন। ডিএপি ১২৯৪ মেঃটন চাহিদার বিপরীতে বরাদ্দ মিলেছে ৫৮৫.৫৪ মেঃটন। টিএসপি ৯২৫ মেঃটনের বিপরীতে বরাদ্দ মিলেছে ৭৬১ মেঃটন। এমওপি ৮৬৮ মেট্রিক টনের বিপরীতে পাওয়া গেছে ৫১৩ মেট্রিক টন।

এমওপি সার কৃষকদের চাহিদা বেশী হওয়ায় অতিরিক্ত ৪৫০০ মেট্রিক টন বেশী বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে এই অতিরিক্ত এমওপি সারের বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। তবে রোববার পর্যন্ত এমওপি সার মজুদ রয়েছে ২৩১ মেট্রিক টন। যা সেপ্টেম্বর মাসে সরবরাহ করা হবে।

চাষীদের অভিযোগ, সার ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারনে তারা সরকারের বেধে দেওয়া দর ও চাহিদা অনুযায়ী সার কিনতে পারছেননা। বেশী দাম দিয়েও ইউরিয়া সহ সব ধরনের সার পাওয়া দুস্কর হয়ে পড়েছে।

বর্তমানে ডিলারদের কাছে পটাশ ও ডিএপি সার পাওয়া যাচ্ছেনা। গ্রামাঞ্চলের খুচরা বিক্রেতাদের কাছে পাওয়া গেলেও দ্বিগুন থেকে তিন গুন দামে কিনতে হচ্ছে। ডিলারদের সাথে যোগসাজশ করে এরা বেশী দামে সার বিক্রি করছে। কোন কোন ডিলার ইউনিয়ন পর্যায়ে বিক্রির জন্য বরাদ্দ পেলেও তারা অন্য এলাকায় গিয়ে সার বিক্রি করছেন।

নলডাঙ্গা উপজেলার ব্রক্ষ¥পুর ইউনিয়নের আকতার হোসেন নামে একজন ডিলার নলডাঙ্গা পৌর এলাকায় গিয়ে সার বিক্রি করেন।

চাষীরা আরো অভিযোগ করে বলেন, সরকার নির্ধারিত প্রতিকেজি ইউরিয়া সারের দাম ১১শ টাকা হলেও তার দাম নেওয়া হচ্ছে ১১৮০ টাকা, এমওপি ৭৫০ টাকার জায়গায় সাড়ে ৮শ, টিএসপি ১৩শ টাকা ও ৮শ টাকার ডিএপি সাড়ে ৮শ থেকে হাজার টাকা নেওয়া হচ্ছে।

সদর উপজেলার কাফুরিয়া গামের কৃষক মেহের আলী বলেন, গত বছরের তুলনায় এবার সারের দাম প্রায় দ্বিগুন হয়ে গেছে। আমরা সরকারী ডিলারদের কাছ থেকে সরাসরি সার কিনতে পারিনা। কৃষিকার্ড না থাকলে ডিলাররা সার দেয়না। তারা স্থানিয় সার ব্যবসায়িদের কাছে সার বিক্রি করে। তাদের কাছ থেকে আমাদের বেশি দামে কিনতে হয়।

নলডাঙ্গা উপজেলার হলুদ ঘর এলাকার কৃষক আলহাজ মিয়া জানান, তিনি দুই বস্তা ইউরিয়া কিনেছেন ১১৮০ টাকা করে। পটাশ সার না থাকায় কিনতে পারেননি।
ডিলার শুভাশীষ বলেন, কার্ড ধারিদের কাছে সরকারী মূল্যে সার বিক্রি করা হয়। তবে খুচরা বিক্রেতারা কৃষকের কাছে কতটাকা দিয়ে সার বিক্রি করে তা তদারকি করার সুযোগ নাই তাদের।

এদিকে একটি সুত্র দাবি করছে,ইতিপুর্বে ক্ষমতাসিন দলের দাপট দেখিয়ে নাটোর বাফার সার গুদামে কোয়েল ও কুত্তা সেলিম নামে দু’টি গ্রুপ ডিলারদের মাঝে সার বিতরন নিয়ন্ত্রন করছিল। সম্প্রতি দুই গ্রুপের মধ্যে একাধিকবার সংর্ঘষের ঘটনায় একাধিক মামলা হয়।

পুলিশি অভিযানের পর বেশ কয়েকজন আটক হয়। এর পর থেকে বাফার গুদামে তাদের আর দেখা মিলছেনা। তবে অপর একটি গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করলেও তারা এখনও প্রকাশ্যে আসেনি।

অভিযোগ রয়েছে,ডিলারদের নামে বরাদ্দকৃত সার সরবরাহেও অনিয়ম করা হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ডিলার বলেন,বিএডিসির গুদাম থেকে সার উত্তোলন করতে গেলে বরাদ্দকৃত সার উত্তোলনের ক্ষেত্রে তাদের শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। বরাদ্দকৃত সার দু’দফা অথবা তিন দফায় সরবরাহ করা হয়। তবে বিশেষ বিশেষ ডিলারের ক্ষেত্রে এই শর্ত থাকেনা না।

বাফার সার গুদামে বিএডিসির গুদাম কর্মকর্তা জাহিদুর রহমান জানান, বরাদ্দ অনুযায়ী সার ডিলারদের মধ্যে সার বিতরণ বা সরবরাহ করা হয়। এখানে কোন ধরনের সিন্ডিকেড নেই। বিএডিসির শ্রমিকরাই ডিলারদের মধ্যে সার সরবরাহ করে থাকেন। বরাদ্দের বাহিরে অতিরিক্ত বা কম সার সরবরাহ করা হয়না।

জেলা ফার্টিলাইজার সমিতির সভাপতি আব্দুস সালাম বলেন, নাটোরে সার ডিলাররা বরাদ্দকৃত সার সরকারি নিয়মেই বিতরণ করে থাকেন। কোন ধরনের সিন্ডিকেট বা অনিয়মের সাথে তারা জড়িত নন। তবে এবার কৃষকদের চাহিদা একটু বেশী হওয়ায় সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। চাহিদা অনুযায়ী পটাশ সার মিলছেনা। বর্তমানে পটাশ সারের মজুদ নেই। একারনে অতিরিক্ত পটাশ সারের চাহিদা চেয়ে জেলা প্রশাসক ও জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বরাবরে আবেদন জানানো হয়েছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের উপপরিচালক আব্দুল ওয়াদুদ জানান, নাটোরে সার নিয়ন্ত্রনে কোন সিন্ডিকেড নেই। এধরনের কোন অভিযোগও নেই। এবিষয়ে রোববার অনুষ্ঠিত জেলা সার ও বীজ মনিটরিং সভায় বিস্তর আলোচনা হয়েছে। জেলা প্রশাসক সকলকে এবিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। এছাড়া বাফার সার গুদামে বহিরাগত কোন গ্রুপের অস্তিত্ব নেই বলে তিনি জানান। যদি থাকে তবে দ্রুতই ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসকের নির্দেশনা অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

কৃষকরা যাতে সহজেই সার নিতে পারেন সেজন্য ইউনিয়ন পর্যায়ের সার ডিলারদের প্রয়োজনে গুরুত্বপুর্ন এলাকায় গিয়ে সার বিক্রির জন্য বলা আছে। যে সব ইউনিয়নে দুজন করে ডিলার রয়েছেন তাদের একজন সরিয়ে গুরুত্বপুর্ন এলাকায় সার বিক্রির জন্য বলা হয়েছে। আকতার হোসেনের ক্ষেত্রে হয়ত সেটি হয়েছে। তবুও খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।

জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, নাটোরে সারের কোন সিন্ডিকেট থাকার বিষয়ে কোন ধরনের অভিযোগ আসেনি তার দপ্তরে। তবে এধরনের অভিযোগ পেলে তাৎক্ষনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে এবং বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজ নেওয়া হবে। এছাড়া ফার্টিলাইজার সমিতির আবেদনের বিষয়টি আইনগতভাবে যা করনীয় তাই করা হবে।

আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, যারা অবৈধভাবে সার মজুদ করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে সরকারের ভাবমুর্তি বিনষ্ট করছে তাদের চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি জেলা প্রশাসন সহ সংশ্লিষ্টদের এবিষয়ে নজরদারি বাড়ানো সহ অসৎ সার ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া নির্দেশ দিয়েছেন।

 

 

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে