মিশেলের বাংলাদেশ সফর এবং প্রাসঙ্গিক কিছু প্রশ্ন

প্রকাশিত: আগস্ট ১৯, ২০২২; সময়: ৯:১০ অপরাহ্ণ |
খবর > মতামত
মিশেলের বাংলাদেশ সফর এবং প্রাসঙ্গিক কিছু প্রশ্ন

ড. প্রণব কুমার পান্ডে : বাংলাদেশের রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো বিরোধীদল সব সময় সরকারের বিরুদ্ধে খুন-গুম এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উত্থাপন করে। ফলে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে অনেক দিন ধরেই এই ধরনের আভিযোগ আনা হচ্ছে বিরোধীদল এবং কিছু মানবাধিকার সংস্থার পক্ষ থেকে।

২০২৩ সালের অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদের দ্বাদশ নির্বাচনকে সামনে রেখে এ বিষয়টিকে আবার সামনে আনার চেষ্টা করছে বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলো। তাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, মানবাধিকারের প্রশ্ন উত্থাপনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে খাটো করা। এটা ঠিক যে কোনো কোনো ক্ষেত্রে হয়তো আইনের যথাযথ প্রয়োগ হয়নি, তবে দেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিভিন্ন ধরনের অতিরঞ্জিত তথ্য প্রকাশের মাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার প্রয়াস রয়েছে বিভিন্ন গোষ্ঠীর।

এই অবস্থার মধ্যে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের প্রধান মিশেল ব্যাচেলেটের সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফর অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে প্রচারিত হয়েছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে। অনেকে ধারণা করেছিলেন যে, মানবাধিকার প্রশ্নে বিভিন্ন ইস্যুতে বাংলাদেশ সরকারের উপরে চাপ প্রয়োগ করবেন মিশেল। সফরকালে তিনি সরকারি এবং বিরোধী দল এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সাথে মতবিনিময় করেছেন। তিনি যেমন একদিকে মানবাধিকার প্রশ্নে সরকারকে আরও কঠোর হওয়ার আবেদন জানিয়েছেন, ঠিক তেমনিভাবে অন্যান্য বিভিন্ন বিষয়ে মত প্রকাশ করেছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি হলো তিনি এই মানবাধিকার বিষয়গুলো তদন্তের জন্য স্বাধীন তদন্ত সংস্থা গঠনের বিষয়ে আইনমন্ত্রীকে তাগিদ দিয়েছেন।

যদিও আইনমন্ত্রীর ভাষায় তিনি পরিষ্কারভাবে এ বিষয়ে কিছু বলেননি। আইনমন্ত্রী মিডিয়ার সামনে কথা বলার সময় উল্লেখ করেছেন যে “স্বাধীন তদন্ত সংস্থা গঠনের বিষয়ে আমার সঙ্গে আলাপে তিনি (মিশেল ব্যাচেলেট) পরিষ্কার করে বলেননি। তিনি নিরপেক্ষ ও স্বাধীন তদন্তের কথা বলেছেন। আমি বলেছি বাংলাদেশের আইনে যা বলা আছে সেটাই হতে হবে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগের বিষয়ে সরকারের নেয়া পদক্ষেপের বিষয়ে তাকে অবহিত করেছি। আমার এসব বক্তব্যের পরে তিনি আমাদের প্রশংসা করেছেন। আমি বুঝতে পারছি না তিনি এখন কী বলতে চাইছেন।” (প্রথম আলো, ১৯ আগস্ট, ২০১৯)। ফলে বিষয়টিতে এক ধরনের ধোঁয়াশা রয়েই গেল।

সরকারের পক্ষ থেকে একটি দল মিশেলের সাথে সাক্ষাৎ করে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। তারা উল্লেখ করেছে যে বাংলাদেশ এবং দেশের বাইরে একটি চক্র মানবাধিকার প্রশ্নে বিভিন্ন মিথ্যা তথ্য প্রদানের মাধ্যমে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে সচেষ্ট রয়েছে। ঠিক তেমনিভাবে বিভিন্ন বিরোধী গোষ্ঠী এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা (যারা সর্বদা সরকারের সকল ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা দেখেন) মিশেলের সাথে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশের মানবাধিকার প্রশ্নে সরকারকে আরও কঠোর হওয়ার বিষয়ে সরকারের উপর চাপ প্রয়োগের কথা বলেছেন।

স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে মানবাধিকার বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করার বিষয়ে আমার কোনো দ্বিমত নেই। কারণ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় যে কোনো ব্যক্তির অধিকার আছে বিচার পাওয়ার। বিচারবহির্ভূত কোনো কার্যক্রম গ্রহণযোগ্য নয়। তবে পাশাপাশি অনেক ক্ষেত্রে বাস্তবতার নিরিখে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। দেশ এবং জনগণের জীবনের জন্য যারা হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে তা মানবাধিকার লঙ্ঘনের মধ্যে পড়ে কি না সে বিষয়টি ভেবে দেখা প্রয়োজন। মিশেলের বাংলাদেশ সফর আন্তর্জাতিক ও দেশীয় মিডিয়ায় অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে প্রচারিত হলেও বেশ কয়েকটি প্রশ্ন অমীমাংসিত রয়ে গেছে।

মিশেল বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য সরকারকে তাগিদ দিয়েছেন। তবে দেশের জনগণ প্রত্যাশা করেছিল তিনি বাংলাদেশে ঢুকে পড়া প্রায় ১৫ লাখ রোহিঙ্গার অবস্থান সম্পর্কে সুস্পষ্ট বক্তব্য প্রদান করবেন। যদিও মিডিয়ার সামনে তিনি বলেছেন যে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যেতে হবে। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে রাখাইন প্রদেশে যখন অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল, সেই সময় জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কমিটির ভূমিকা কী ছিল? কিংবা সেই নির্যাতনের বিচারে জাতিসংঘ কি ভূমিকা রেখেছে? ভবিষ্যতে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় এই জনগোষ্ঠী মিয়ানমারে ফিরে গেলে তাদের উপর যে নির্যাতন হয়েছে সেটির বিচার হবে কি? কিংবা তারা ফিরে যাওয়ার পরে তাদের উপর আবারো নির্যাতন হবে না-এই মর্মে জাতিসংঘ কি কোনো রকম নিশ্চয়তা প্রদান করতে পারবে? বাংলাদেশে যারা আজকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা বলছেন তারা এই বিষয়টিকে কীভাবে বর্ণনা করবেন?

রাখাইন প্রদেশের এই বিপুলসংখ্যক নির্যাতিত মানুষকে দেশে অবস্থান করবার সুযোগ এবং বাঁচবার অধিকার প্রদানের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যে মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছেন সেটি কি মানবাধিকারের বিষয় নয়? শেখ হাসিনা শুধুমাত্র বাংলাদেশে তাদের থাকবারই অনুমতি দেননি, এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে সকল সুযোগ-সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করতে গিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে একটি বড় ঝুঁকিতে ফেলেছেন। যদিও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এই জনগোষ্ঠীকে সহায়তা প্রদান করছে।

তারপরে কোভিড-১৯ অতিমারি এবং তৎপরবর্তী বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে দেশের অর্থনীতি এমনিতেই চাপের মধ্যে আছে। তার পরে এই বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য বাংলাদেশ সরকারকে ব্যাপক চাপ সহ্য করতে হচ্ছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা যদি খুব শক্তিশালী সংস্থা হয়ে থাকে এবং বিশ্ব মানবতা রক্ষায় তারা যদি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে থাকে তবে বাংলাদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টির সাথে সাথে এই ব্যাপক জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার রক্ষা করা তাদের প্রথম দায়িত্ব।

সাম্প্রতিককালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বিচারে যেভাবে মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে-সেই সমস্ত মানুষের মানবাধিকার রক্ষার বিষয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার ভূমিকা কী? উন্মুক্ত অস্ত্র কেনার অধিকার নিয়ে যেভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্কুল শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বয়স্ক মানুষদের নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে, সেখানে কিন্তু জাতিসংঘ একেবারে নিশ্চুপ রয়েছে। তখন কিন্তু তারা মার্কিন প্রশাসনের উপরে কোনো রকম চাপ সৃষ্টি করতে পারছে না। কিংবা এটা বলতে পারছে না যে একটি স্বাধীন তদন্ত সংস্থার মাধ্যমে এর বিচার করা হোক। অথবা অস্ত্র আইনের পরিবর্তন এনে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করা হোক।

জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার এই ধরনের দ্বৈত অবস্থান তাদের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে বলে অনেকেই মনে করে।
এটি নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে সাম্প্রতিক সময়ে মিশেলের বাংলাদেশ সফর আগামী নির্বাচন এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। তবে তার এই সফরকে শুধুমাত্র একপাক্ষিকভাবে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগের সফর হিসেবে যারা দেখছেন তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশ সরকার যে অবস্থান তৈরি করেছে সেখানে ভিত্তিহীন চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে সরকারকে চাপে ফেলা যাবে না। যদিও বিভিন্ন ধরনের খুন ও গুমের অভিযোগ বিরোধী দলের পক্ষ থেকে ঢালাওভাবে প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে নিজেদের অন্তদ্বন্দ্বের কারণে অনেকেই গুম হয়েছেন, কিংবা খুনের শিকার হয়েছেন। সেই বিষয়গুলো মিশেলের বক্তব্যে আরও জোরালোভাবে আসার প্রয়োজন ছিল বলে দেশের বেশির ভাগ মানুষ মনে করে।

দেশে মানবাধিকার রক্ষার প্রশ্নে সরকার ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে-এ বিষয়ে দ্বিমত করার কোনো অবকাশ নেই। তবে এটি ঠিক অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের মতো দেশে প্রশাসন কিংবা দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভাগের ব্যক্তিদের অতি উৎসাহী ভূমিকার কারণে সরকার অনেক ক্ষেত্রেই সমালোচিত হয়। সেটি যেমন সরকারকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে, ঠিক তেমনিভাবে জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থাকেও সঠিক তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে কোনো দেশের মানবাধিকারের বিষয়ে কথা বলতে হবে।

বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি যদি খুব খারাপ হয়ে থাকে, তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতি আরও অনেক বেশি খারাপ। এমনকি রাশিয়া এবং ইউক্রেনের যুদ্ধের ফলে ইউক্রেনে যেভাবে নির্বিচারে মানুষ মেরে ফেলা হচ্ছে সেখানেও জাতিসংঘ কতটুকু শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পেরেছে-সেটিও কিন্তু বিশ্বব্যাপী মানুষের মাধ্যে তাদের সক্ষমতা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্নের উদ্রেক করেছে।

অতএব আমরা সকলেই চাই সরকার দেশের সকল নাগরিকের মানবাধিকারের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে যে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক বিভাগের কাজ হচ্ছে পৃথিবীর সকল দেশে যেখানেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটবে সেখানে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করা। কিন্তু এই সংস্থাটি অনেক ক্ষেত্রেই সেটি করতে ব্যর্থ হচ্ছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে মিশেলের বাংলাদেশ সফরকে আমি ইতিবাচকভাবেই দেখি। কারণ সরকারের সুযোগ হয়েছিল তাদের অবস্থান তার কাছে ব্যাখ্যা করার।

তার সাথে আলোচনার প্রেক্ষিতে সরকারের যদি কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার সুযোগ থাকে সেটি গ্রহণ করার মাধ্যমে মানবাধিকার পরিস্থিতি আরও শক্তিশালী করবে যা তাদের জন্য ইতিবাচক হবে। আমরা জানি যে বাংলাদেশের নেতৃত্বে রয়েছেন জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনা। আমি বিশ্বাস করি তিনি কখনই চাইবেন না দেশের মানুশের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হোক। তবে মিশেলের সাম্প্রতিক সফরকে যারা সরকারের উপর আরেকটি চাপ হিসেবে বিবেচনা করছেন তারা দিবা স্বপ্ন দেখছেন বলেই আমার বিশ্বাস।

লেখক- রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের প্রফেসর।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে