দুই মেয়ের শেষ কথা, বত্রিশে মোশতাক, কে এই আন্ধা হাফেজ?

প্রকাশিত: আগস্ট ১৩, ২০২২; সময়: ১১:০০ পূর্বাহ্ণ |
দুই মেয়ের শেষ কথা, বত্রিশে মোশতাক, কে এই আন্ধা হাফেজ?

পদ্মাটাইমস ডেস্ক :  ১৩ আগস্ট। বুধবার। সকাল ১১টায় যুক্তরাষ্ট্রে নবনিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এমআর সিদ্দিকী বিদায়ী সাক্ষাৎ করেন। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় চাঁদপুরের এমপি এমএ রব সাক্ষাৎ করেন।

সন্ধ্যায় মাকে ফোন করলেন হাসিনা। মা ফজিলাতুন্নেছা বললেন, দ্রুত দেশে ফিরে এসো।

কী হয়েছে মা?

তোমার আব্বার তোমাদের খুব প্রয়োজন। সব কথা ফোনে বলা সম্ভব নয়।

মায়ের কথা শুনে চিন্তিত হাসিনা।

বাবার সঙ্গে শেষ কথা হলো শেখ রেহানার।

‘টেলিফোনে আব্বাকে বললাম, আমি দেশে আসতে চাই, আমার একদম ভালো লাগছে না। আমার কথা শুনেই তিনি হো হো করে হেসে উঠলেন। সান্ত্বনার স্বরে বললেন, ‘কিরে, আগে বলিনি, ঠিক আছে টিকিট পাঠাবার ব্যবস্থা করছি, মন খারাপ করিস না। এই তাঁর সাথে আমার শেষ কথা।’

হু কিলড মুজিব বইয়ে এ এল খতিব জানাচ্ছেন, ‘১৩ আগস্ট যখন মোশতাক মুজিবের বাড়িতে তার সাথে দেখা করেন সেদিন তিনি রাসেলের প্রতি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি স্নেহপ্রবণ ছিলেন।’

এদিকে চট্টগ্রামে আন্ধা হাফেজের কাছে গেছেন খুনি ফারুকে স্ত্রী ফরিদা।

ম্যাসকারেনহাস জানাচ্ছেন, ‘১৯৭৫ সালের ১৪ ই আগষ্ট। বেলা এগারোটা ছাড়িয়েছে কেবল। সময় যেন অতি দ্রুত নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। চট্রগ্রামের এক বাজারের মাঝামাঝি এসে তার ট্যাক্সি বিকল হয়ে পড়েলো। বিকল গাড়িতে বসে মেজর ফারুকের স্ত্রী ফরিদা অস্থির হয়ে পড়লেন। দুঃশ্চিন্তায় ঘেমে একেবারে গোসল করার উপক্রম। এক ঘন্টারও বেশি সময় ধরে তিনি হালিশহরে অবস্থানরত আন্ধা হাফিজের কাছে একটা জরুরি খবর পৌছানোর চেষ্টা করছিলেন। ফরিদা ঢাকা থেকে এর আগের দিন বিকেলে চট্রগ্রাম এসেছেন। সঙ্গে তার মাও ফিরেছেন। ফারুক তাকে অন্ধ দরবেশের সঙ্গে আলোচনা করতে পাঠিয়েছেন। ফারুকের স্পষ্ট নির্দেশ : আন্ধা হাফিজকে বলবে, আমি ১৫ তারিখেই কাজটা করতে যাচ্ছি। আল্লাহর প্রতি সম্পূর্ণ বিশ্বাস রেখে দেশের জন্যই আমি এ কাজটি করতে যাচ্ছি। আমি যা করছি তা জনগণের মঙ্গলের জন্যই করছি। আমি চাই তিনি আমাকে বলুক আমি ঠিক পথে আছি নাকি ভুল করছি। তিনি যদি অন্য কিছু করতে বলেন-আমি তাই করবো। ফারুক ফরিদাকে দুপুরের মধ্যেই আন্ধা হাফিজের মন্তব্য টেলিফোনে জানিয়ে দিতে বলেছিলেন। ..ফরিদা গিয়ে দেখলো দরবেশ আন্ধা হাফিজ লুঙ্গি ও সুতির গেনজি গায়ে পায়ের উপর পা তুলে একটি নীচু চৌকিতে বসে আছেন। একটা কাপড় তার কামড়ায় ঝুলছিল। ফরিদা একটা বেতের মোড়ায় গিয়ে বসলো। অন্ধ দরবেশ ফরিদার হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে নীরবে ফারুকের পাঠানো সংবাদ শুনে নিলেন। তারপর একটা দীর্ঘনি:শ্বাস ফেলে আবেগজড়িত কন্ঠে উর্দু ভাষায় বললেন, তার সময় ফুরিয়ে এসেছে। তোমাদের যা করার করে ফেলো। তবে অত্যন্ত গোপনে কাজটা করতে হবে। আবারো এক লম্বা নীরবতা। তারপর তিনি ফরিদাকে বললেন, ‘ফারুককে বলো কাজটা শুরু করার আগে সে যেন আল্লাহর রহমতের জন্য দোয়া করে নেয়। তার সাথীরাও যেন একইভাবে দোয়া করে নেয়। দুটি সুরা দিলাম। সে যেন অনবরত তা পাঠ করতে থাকে। তাহলে তার মন পবিত্র থাকবে। পবিত্র চিন্তা ছাড়া সে আর অন্য চিন্তা করতে পারবে না। ফরিদা বিদায় নেওয়ার জন্য উঠে দাড়ালো। যাবার পূর্ব মূহুর্তে সে তার স্বামী ও সাথীদের জন্য দোয়া করতে আন্ধা হাফিজকে অনুরোধ জানালো। আন্ধা হাফিজ তাকে সান্তনা দিয়ে বললেন, ’ চিন্তা করো না। আমি তাদের আল্লাহর হাতে সপে দিয়েছি। এটা তার ইচ্ছা। তিনিই তাদের রক্ষা করবেন।’

আন্ধা হাফেজের যা বললেন
সাপ্তাহিক বিচিন্তার এক সাক্ষাৎকারে আন্ধা হাফিজ উক্ত সম্পৃক্ততার দাবি অস্বীকার করে এবং মাস্কারেনহাসকে মিথ্যাবাদী বলে সাব্যস্ত করে। তার বক্তব্যমতে, অ্যান্থনী ম্যাসকারেনহাস আসলে আমার কাছে কোনদিন আসেননি। কোন রাজনৈতিক দলের লোকের কাছ থেকে সে হয়তো ইনফরমেশন নিয়েছে। আসলে, কর্নেল ফারুক-রশীদ ভায়রা ভাই। দু্ই বোনকে তারা বিয়ে করেছে। তাদের স্ত্রীরা শিল্পপতি এ, কে খানের ভাগ্নি। এরা বহু আগে থেকেই আমার কাছে আসতো। এরা সবসময় আমাকে বলতো, হুজুর আমাদের জন্য দোয়া করবেন। আমরা যেন একসাথে মিলেমিশে থাকতে পারি। তাড়াতাড়ি যেন আমাদের বিয়ে হয়। আমিও তাদের দোয়া করি। আর দোয়ার কারণেই তাদের দুজনের বিয়ে হয় কর্নেল ফারুক-রশীদের সাথে।

‘এরাও বিয়ের আগে থেকেই আমার কাছে আসতো। আমিতো কাউকে মানা করতে পারি না। চোর হোক, গুন্ডা হোক, সবাই আমার কাছে আসবে। সবাইকে আমি দোয়া করি। এটা বানোয়াট একটা কাহিনীমাত্র। আমি শুনতে পাই আমার নাম উল্লেখ করে বইটায় লেখা হয়েছে। আমার ছবি ছাপা হয়েছে। কে আমার ছবি তুলে নিয়েছে আমি টের পাইনি। কিন্তু আমার কাছে কোন সাংবাদিক এসে প্রশ্ন করা, স্টেটম্যান নেওয়া, এসব কেউ কোনদিন নেয়নি। কিন্তু কিছুদিন পর শুনলাম আমি নাকি কর্নেল ফারুককে দোয়া করেছি এবং আমার দোয়া পেয়েই ফারুক শেখ মুজিবকে হত্যা করেছে। প্রকৃত সাধক যারা, তারা মানুষকে ভালোবাসে। তারা কখনো কোন মানুষকে হত্যার জন্য দোয়া দিতে পারে না।

‘ছোটবেলা থেকেই আমি মানুষের উপকার করে আসছি, কিন্তু কেউ বলতে পারবে না.. আমি কারো ক্ষতি করেছি। ম্যাসকারেনহাসের বইতে যখন আমার নামটা আসছে, তখন বিদেশ থেকে ভক্তরা আমাকে ঘটনাটা জানায়। আমি এতে প্রচন্ড দুঃখ পাই। গ্ল্যাকসো বাংলাদেশের তখনকার চেয়ারম্যান ছিলেন ব্যারিষ্টার রশীদুজ্জামান, আমার মুরিদ। উনি কি এক কাজে তখন লন্ডন ছিলেন। উনি খবর পেয়ে লন্ডন থেকে আমাকে ফোন করেন এবং বলেন, ‘হুজুর আপনার বিরুদ্ধে এসব লেখা হয়েছে।’ আমি বললাম, আমার কাছেতো কেউ আসেনি। এটা সম্পূর্ণ বানোয়াট এবং মিথ্যা। রশীদুজ্জামান ম্যাসকারেনহাসের সাথে দেখা করেন এবং ম্যসকারেনহাসকে বললেন, ‘আপনি হুজুরের সর্ম্পকে যেসব কথা লিখেছেন সেগুলো কি আপনি কনফার্ম হয়ে বলেছেন? হুজুরের সাাক্ষাতকার নিয়ে বলেছেন? ম্যাসকারেনহাস এতে অনুতপ্ত হলেন। তিনি রশীদুজ্জামানকে বললেন, আমি বাংলাদেশে এসে হুজুরের কাছে মাফ চেয়ে যাব। ব্যারিষ্টার রশীদ ফোনে আমাকে সব কথা জানায়। আমি রশীদকে বললাম, সে হয়তো আমার কাছে মাফ চাওয়ার সুযোগ পাবে না। আসলেও সে সুযোগ পায়নি। এর কিছুদিন পরই ম্যাসকারেনহাস হার্ট অ্যাটাকে মারা যান।’

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে