পাবনায় ভূল চিকিৎসায় শিশু তাসিম হারালো তিন আঙুল

প্রকাশিত: আগস্ট ৪, ২০২২; সময়: ৪:৩২ অপরাহ্ণ |
পাবনায় ভূল চিকিৎসায় শিশু তাসিম হারালো তিন আঙুল

রাজিউর রহমান রুমী, পাবনা : পাবনায় চিকিৎসকের অবহেলা ও সঠিকভাবে ইনজেকশন পুশ না করায় ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়া এক বছরের শিশু তাসিম মোল্লার তিনটি আঙুল কেটে ফেলতে হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। শিশু তাসিম মোল্লা পাবনা সদর উপজেলার গাছপাড়া এলাকার জাহিদুল ইসলাম জাহিদের ছেলে। গত ১০-১৮ জুন পর্যন্ত পাবনা জেনারেল হাসপাতালের ডায়রিয়া ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন ছিল তাসিম। ঘটনার প্রতিকার চেয়ে পাবনার সিভিল সার্জনসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন শিশুর বাবা জাহিদ।

শিশু তাসিমের বাবা জাহিদুল ইসলাম জাহিদ অভিযোগ করে জানান, তার এক বছর বয়সী শিশু তাসিম মোল্লা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হলে ১০ জুন পাবনা জেনারেল হাসপাতালের ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় ১২ জুন সকালে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রের নির্দেশনা অনুযায়ী কর্তব্যরত নার্স শিশু তাসিমকে ইনজেকশন পুশ করেন। কিন্তু ইনজেকশনটি রগে (রক্ত নালীতে) প্রয়োগ করার নির্দেশনা থাকলেও, সংশ্লিষ্ট পুরুষ নার্স মাংসপেশিতে ইনজেকশন প্রয়োগ করেন।

ইনজেকশন পুশ করার পর থেকেই বাচ্চার ডান হাত ফুলতে থাকে এবং বাচ্চা ব্যাথার যন্ত্রনায় চিৎকার করতে থাকে। বাচ্চার ব্যাথা ও কান্নার কারণে ডিউটিরত নার্সদেরকে বারবার দেখালে তারা বলেন, ঠিক হয়ে যাবে। ইনজেকশন পুশ করার স্থানে (ডান হাত) ক্রমান্বয়ে লালাভ-বেগুণী বর্ণ ধারণ করে এবং তার বাচ্চা অনবরত যন্ত্রনায় কাঁদতে ও ছটফট করতে থাকে। সে সময় কর্তব্যরত চিকিৎসককে দেখালে তিনি ক্ষত স্থানে বরফ দিতে বলেন এবং নাপা সিরাপ খাওয়াতে বলেন।

এরপর ১৩ জুন কর্তব্যরত চিকিৎসককে দেখালে তিনি পেসক্রিপসনে একটি মলম লিখে দেন এবং লাগাতে বলেন। ১৪ জুন তারিখে কর্তব্যরত আরেক চিকিৎসককে দেখালে তিনি তার বাচ্চাকে শিশু ওয়ার্ডে রেফার্ড করে দেন। শিশু তাসিমের অনবরত কান্নায় তারা বারবার কর্তব্যরত ডাক্তার-নার্সদের শরণাপন্ন হন। তারা সবাই ঠিক হয়ে যাবে বলে এড়িয়ে যান।

১৮ জুন কর্তব্যরত চিকিৎসককে দেখালে চিকিৎসক শিশুকে রক্ত দিতে বলেন। তারা শিশুকে এক ব্যাগ রক্ত দেয়ার ব্যবস্থা করেন। ওইদিনই রাত ১২টার দিকে শিশু তাসিমকে নিয়ে হাসপাতাল ত্যাগ করেন তার বাবা-মা। ২১ জুন হাসপাতালে বহির্বিভাগে টিকেট কেটে চিকিৎসককে দেখালে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ডা. নীতিশ কুমার শিশুকে আবারও রক্ত দিতে বলেন। সবাই বলেন ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু কেউ বিষয়টির গুরুত্ব দেননি বলে অভিযোগ জাহিদুল ইসলামের।

এদিকে গত ৪ জুলাই হাসপাতালের সহকারী পরিচালক চিকিৎসক ওমর ফারুক মীরের কার্যালয়ে জাহিদুল ইসলাম অভিযোগ জানাতে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাকে হাসপাতালে পাননি জাহিদ। এ সময় তার কক্ষে থাকা কয়েকজন তাকে হাসপাতাল এর রোগী ভর্তির ফরম এর মূল কপি রেখে ফটোকপি হাতে ধরিয়ে দেন।

এরপর তিনি তার শিশু তাসিমকে শহরের একটি প্রাইভেট মেডিক্যাল কনসালটেশন সেন্টারে চিকিৎসক জাহেদী হাসান রুমীকে দেখান। সেই চিকিৎসক শিশুটিকে ঢাকার শিশু হাসপাতালে দেখানোর পরামর্শ দেন। সেই পরামর্শে তারা ঢাকার শিশু হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানকার চিকিৎসকরা শিশুটিকে পঙ্গু হাসপাতালে রেফার্ড করেন। ৬ জুলাই শিশুটিকে ঢাকার শেরেবাংলাস্থ পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসককে দেখানো হয়। সেখানকার চিকিৎসকরা সার্জারির মাধ্যমে শিশুটির ডান হাতের তিনটি আঙ্গুল কেটে ফেলতে বলেন। চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন, অনেক দেরী হওয়ার কারণে আঙুল কাটা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।

শিশুটির বাবা জাহিদ জানান, ঢাকার ক্লিনিকে ব্যয়বহুল হওয়ায় তিনি পাবনা চলে আসেন। এরপর গত ২৯ জুলাই পাবনার একটি বে-সরকারি হাসাপাতালে অপারেশনের মাধ্যমে তার শিশুর ৩টি আঙ্গুল কেটে ফেলা হয়। আঙুল কেটে ফেলার পর থেকে স্বাভাবিক আচরণ করছে শিশু তাসিম।

তাসিমের বাবা জাহিদুল ইসলাম বলেন, তার শিশুটির অনাগত ভবিষ্যত নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার সন্তানটি গুরুত্বপূর্ণ ডান হাতটির তিনটি আঙুল হারালো। তিনি বলেন, তার শিশুর ক্ষেত্রে যে অবহেলা করা হয়েছে তার বিচার হওয়া উচিত। তা না হলে এমন ঘটনা আরও ঘটবে। যে চিকিৎসক ও নার্সদের অবহেলা এর জন্য দায়ী তাদের বিচার দাবি করেন জাহিদ।

হাসপাতালের অর্থোপেডিট বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জাহেদী হাসান রুমী বলেন, একদিন ওই শিশুকে নিয়ে তার বাবা আমার চেম্বারে এসেছিলেন। ততদিনে শিশুটির হাতে পঁচন ধরেছিল। আমি দেখেই বলেছিলাম আঙুল কেটে ফেলা ছাড়া উপায় নেই। তখন শিশু বাচ্চা দেখে তারা ভয় পেয়েছিল। তখন তাকে ঢাকার শিশু হাসপাতালে নিয়ে যাবার পরামর্শ দেই। এর বেশি কিছু জানি না।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে পাবনার সিভিল সার্জন চিকিৎসক মনিসর চৌধুরী বলেন, এ বিষয়ে জাহিদুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তির একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছেন। খুব শীঘ্রই একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। তদন্তে কোনো চিকিৎসক বা নার্সের অবহেলা জড়িত থাকার প্রমাণ পেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

হাসপাতালের সহকারী পরিচালক চিকিৎসক ওমর ফারুক মীর বলেন, ওই শিশুর বাবা আমার কাছে লিখিত বা মৌখিক কোনো অভিযোগ দেয়নি। বিভিন্ন মাধ্যমে আমি বিষয়টি জেনেছি। জানার পর আজ তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। তাদের প্রতিবেদন পেলে জানা যাবে প্রকৃত ঘটনা আসলে কি ঘটেছিল। তদন্তের স্বার্থে এর বেশিকিছু বলতে চাননি তিনি।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে