সুজানগরে ৬ কোটি টাকার পানি প্রকল্পে দুর্নীতির তদন্তে যুগ্নসচিব

প্রকাশিত: জুলাই ৩১, ২০২২; সময়: ৬:১৩ অপরাহ্ণ |
সুজানগরে ৬ কোটি টাকার পানি প্রকল্পে দুর্নীতির তদন্তে যুগ্নসচিব

এম এ আলিম রিপন, সুজানগর : সুজানগর পৌরসভার আর্সেনিকমুক্ত সুপেয় পানি সরবরাহ ও পানি নিষ্কাশনের জন্য ২০১০-১১ অর্থ বছরে পাইপ ওয়াটার সাপ্লাই এন্ড এনভায়রনমেন্টাল স্যানিটেশন প্রকল্পে পাবনার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী এবং বর্তমানে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, খুলনা সার্কেল খুলনার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জামানুর রহমানের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতা ও ব্যাপক অনিময়ের দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত করলেন স্থানীয় সরকার বিভাগের যুগ্নসচিব(পাস অধিশাখা) ও পাবনার সাবেক জেলা প্রশাসক মো.জসিম উদ্দিনের নেতৃত্বে ৩ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি।

রবিবার (৩১ জুলাই) দিনব্যাপী সুজানগর পৌরসভার বিভিন্ন স্থানে এই প্রকল্পের অনিয়ম ও দুর্নীতির সরেজমিন তদন্ত করার পাশাপাশি এ বিষয়ে ভূক্তভোগী স্থানীয় বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিদের সাথে কথা বলেন। তদন্তকালে পাবনা স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক মোখলেছুর রহমান,পাবনার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী এবং বর্তমানে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর,খুলনা সার্কেল খুলনার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জামানুর রহমান, সুজানগর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহীনুজ্জামান শাহীন,পৌর মেয়র রেজাউল করিম রেজা, সাবেক পৌর মেয়র আলহাজ্ব আব্দুল ওহাব, সাবেক পৌর মেয়র তোফাজ্জল হোসেন তোফা, পাবনা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী আতিকুল ইসলাম, পৌরসভার নির্বাহী কর্মকর্তা গোলাম নবী, সুজানগর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপ সহকারী প্রকৌশলী মনিরুল ইসলাম, সাবেক উপ সহকারী প্রকৌশলী মামুনর রশীদ, সুজানগর প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও দৈনিক যুগান্তরের উপজেলা প্রতিনিধি এম এ আলিম রিপন,আনন্দ টিভির জেলা প্রতিনিধি সেলিম মোর্শেদ রানা উপস্থিত ছিলেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সুজানগর পৌরসভার আর্সেনিকমুক্ত সুপেয় পানি সরবরাহ ও পানি নিষ্কাশন প্রকল্পে রবিবার সরেজমিন প্রাথমিক তদন্তে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য পায় তদন্ত কমিটি। উল্লেখ্য পাবনার সুজানগর পৌরসভায় আসেনিকমুক্ত সুপেয় পানি ও নিস্কাশন ব্যবস্থায় ৫ কোটি ৬৭ লাখ টাকা ব্যয় হলেও বিগত ৬ বছরে এর কোন সুফল পাচ্ছে না সুজানগর পৌরবাসী। ব্যাপক দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের কারণে মুখ থুবড়ে পড়ে প্রকল্পটি। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ ও হতাশ ভুক্তভোগীরা। সংশ্লিষ্ট সুত্র জানায়,সরকার সুজানগর পৌরসভার আর্সেনিকমুক্ত সুপেয় পানি সরবরাহ ও পানি নিষ্কাশনের জন্য ২০১০-১১ অর্থ বছরে পাইপ ওয়াটার সাপ্লাই এন্ড এনভায়রনমেন্টাল স্যানিটেশন প্রকল্প হাতে নেয়।এর জন্য বরাদ্দ দেয়া হয় ৫ কোটি ৬৭ লাখ টাকা।

এই প্রকল্পের আওতায় সুজানগর পৌর এলাকায় ২০০মিঃমিঃ ব্যাসের ১.১০ কিঃমিঃ, ১৫০ মিঃমিঃ ব্যাসের ৪.৪২ কিঃমিঃ, ১০০ মিঃমিঃ ২৩.৯৮ কিলোমিটার পাইপ লাইন স্থাপন, উৎপাদক নলকূপ ০৫টি, পাম্প ঘর ৫টি, পাম্প ও মোটর ক্রয় ৫টি, সারফেস ড্রেন ৫ কিলোমিটার, ডাস্টবিন ১২টি, পাবলিক টয়লেট ০৪টি, তারা নলকূপ স্থাপন ৩০টি, অটো ভোল্টেজ রেগুলেটর ক্রয় ০৫টি,২টি কম্পিউটার ও ১৪২৫টি বাড়িতে পানির মিটার সংযোগ দেয়ার সিদ্ধান্তÍ হয়। পাবনার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী এবং বর্তমানে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর,খুলনা সার্কেল খুলনার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জামানুর রহমান এই প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হন। এ প্রকল্পের পিডি নিজেই টেন্ডার আহ্বানকারী ও বিল পরিশোধকারী হওয়ায় তিনি তৎকালীন সুজানগর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপ-সহকারী প্রকৌশলী ও পছন্দের পাবনার ঠিকাদারকে দিয়ে যেনতেনভাবে ৫ কোটি ৬৭ লাখ টাকা খরচ দেখান এবং তিনি তার স্বেচ্ছাচারিতা ও ব্যাপক অনিময়ের দুর্নীতির মাধ্যমে যেনতেনভাবে প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত করেন বলে অভিযোগ প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের।

নিম্নমানের পাইপ দিয়ে পানির লাইন বসানোর কারণে পানি ছাড়ার সাথে সাথে তা ফেটে চৌচির হওয়ায় নির্মাণের পর থেকে পৌর এলাকায় পানি সরবারাহ বন্ধ রয়েছে। ডিপ টিউবয়েল গুলো বসানোর পর থেকে অকেজো হয়ে আছে। এমনকি পাম্প ঘর নির্মাণের পর থেকে এখন পর্যন্ত চরভবানীপুর এলাকার পাম্প ঘর সহ ২টি পাম্প ঘরে বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকলেও পাম্প ঘরে বিদ্যুৎতের মাধ্যমে পাম্প ও মোটর সচল দেখিয়ে এবং প্রকল্পের অন্যান্য কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন করা হয়েছে উল্লেখ করে ২০১৫ সালের জুন মাসের ২৯ তারিখের মধ্যেই ৫ কোটি ৬৭ লাখ টাকা উত্তোলন করে নেওয়া হয় অভিযোগ রয়েছে,এ প্রকল্প থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। বর্তমানে প্রকল্পটি পৌরবাসীর কোন উপকারেই আসছেনা।এ বিষয়ে সুজানগর পৌরসভার পক্ষ থেকে ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসের ৫ তারিখে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে লিখিত অভিযোগ করা হয়।

অভিযোগে প্রকল্পটিতে ব্যবহার করা সকল পাইপ লাইনে নিম্নমানের পাইপ ব্যবহার করার কারণে নলকুপ ও পাম্প হাউজ অকেজো হয়ে পড়ে আছে বলে উল্লেখ করা হয়। তদন্তে এর সত্যতা মেলায় ২০১৯ সালের মার্চ মাসের ১৪ তারিখে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব আবু নাছের সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে পৌরসভায় আসেনিকমুক্ত সুপেয় পানি ও নিস্কাশন ব্যবস্থা সচল করতে লিখিতভাবে নির্দেশনা প্রদান করেন। সেই নির্দেশনা ৩ বছর পার হলেও তা খাতা কলমেই রয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি।পৌরসভা সুত্রে জানাযায় এই প্রকল্পের মাধ্যমে পৌরবাসীর আসেনিকমুক্ত সুপেয় পানির কোন ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত করা হয়নি। অথচ ৫জন পাম্প চালক ও ১জন মেকানিক্স এর বেতন,বিদ্যুৎ বিল সহ অন্যান্য খরচ বাবদ ২০ লক্ষাধিক টাকা পৌরসভা থেকে প্রদান করতে হচ্ছে প্রতিবছর। পাম্প চালকেরা জানান, পাম্প চালু করার সাথে সাথেই পাইপ ফেটে চৌচির হয়ে যায়।তাই বন্ধ করে রাখা হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় পানির পাইপ লাইন বসানো হলেও জনসাধারণের পানি সরবরাহ কাজে ব্যবহার করা যাচ্ছেনা।

এদিকে এ বিষয়ে গত বছরের ৯ মে রোববার সর্বপ্রথম দৈনিক যুগান্তরে সুজানগরে ভেস্তে গেছে সুপেয় পানি প্রকল্প শীর্ষক শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয় এবং পরবর্তীতে ১১জুন একটি বেসরকারী টিভি চ্যানেলে বিষয়টির উপর একটি প্রতিবেদন প্রচারিত হলে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নজরে আসে। পরবর্তীতে পাবনার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী এবং বর্তমানে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর,খুলনা সার্কেল খুলনার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জামানুর রহমানের বিরুদ্ধে প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত না করেই সমস্ত টাকা উত্তোলনসহ ব্যাপক অনিয়ম,দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়।

এবছরের গত ১৯ জুলাই ৪৬.০০.০০০০.০৮৩.২৭.০০৫.২২-৩৭৩ নং স্মারকে স্থানীয় সরকার,পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় স্থানীয় সরকার বিভাগ পাস-১ শাখার উপ সচিব পঙ্কজ ঘোষ স্বাক্ষরিত পত্রের মাধ্যমে জানা যায়, স্থানীয় সরকার বিভাগের যুগ্নসচিব(পাস অধিশাখা) মো.জসিম উদ্দিনকে আহবায়ক,স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী,স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর(প্রধান প্রকৌশলী,স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর কর্তৃক মনোনীত একজনকে সদস্য এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব(পাস-২) এ.কে এম সাইফুল আলমকে সদস্য সচিব করে ওই কমিটি গঠন করা হয়।

৩১ জুলাই রবিবার ওই তিন সদস্য বিশিষ্ট কমিটি পাবনার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী এবং বর্তমানে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর,খুলনা সার্কেল খুলনার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জামানুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগের সরেজমিন তদন্তে সুজানগর পৌরসভায় আসেন এবং প্রাথমিক তদন্তে এর সত্যতা পান। এদিকে সুপেয় পানি বঞ্চিত সুজানগর পৌর এলাকার বাসিন্দারা এ প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে