কোরবানির সময় ৪টি বড় ভুল থেকে সাবধান

প্রকাশিত: জুলাই ৮, ২০২২; সময়: ১১:৪৭ পূর্বাহ্ণ |
কোরবানির সময় ৪টি বড় ভুল থেকে সাবধান

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : কোরবানি ইসলামের একটি শিয়ার বা মহান নিদর্শন। কোরআন মাজিদে আল্লাহ তাআলা কোরবানির নির্দেশ দিয়ে বলেন- ‘আপনি আপনার রবের উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ুন এবং কোরবানি আদায় করুন’ (সুরা কাউসার: ২)। এই মহান ইবাদত সম্পাদন করতে গিয়ে মারাত্মক কিছু ভুল হয়ে যায় অনেকের। যে ভুলগুলো কোরবানিকে অর্থহীন করে দিতে পারে। এ সম্পর্কিত অন্যতম ৪টি ভুল নিয়ে আলোচনা করা হলো।

উদ্দেশ্য সঠিক না হওয়া: অনেকে ভুল বা অশুদ্ধ নিয়তে কোরবানি করেন। যেমন প্রতি বছর কোরবানি করে থাকি, এ বছর না করলে বাচ্চা-কাচ্চার মন ছোট হবে অথবা আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে ছোট হয়ে যাব। আবার অনেকে চিন্তা করেন, গোশত তো এমনিতেই কিনতে হয়, তার চেয়ে কোরবানি করলে ফ্রেশ গোশত পাওয়া যাবে। এসব উদ্দেশ্য থাকলে কোরবানি করা আর না করা সমান। বরং সেটি শিরকে আসগরে পরিণত হতে পারে। মাহমুদ ইবনে লাবিদ (রা.) বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন—

‘আমি যে বিষয়টি তোমাদের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি ভয় পাই, তা হলো শিরকে আসগর (ছোট শিরক)। সাহাবিরা প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! শিরকে আসগর কী? তিনি বলেন, রিয়া বা লোক দেখানো আমল। কেয়ামতের দিন যখন মানুষকে তাদের কর্মের প্রতিফল দেওয়া হবে, তখন মহান আল্লাহ তাদেরকে বলবেন, তোমরা যাদের দেখাতে তাদের কাছে যাও, দেখো তাদের কাছে তোমাদের পুরস্কার পাও কি না!’ (আহমদ, আল-মুসনাদ: ৫/৪২৮-৪২৯; হাইসামি, মাজমাউজ জাওয়ায়েদ: ১/১০২। হাদিসের মান- সহিহ)

নিয়ত শুদ্ধ হলে আল্লাহ তাআলা জাগতিক কাজকেও ইবাদতের মর্যাদা দিয়ে দেন। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘নিশ্চয় কাজের ফলাফল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল’ (বুখারি: ১)। সুতরাং কোরবানি হতে হবে শুধুমাত্র আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে। এজন্যই প্রতিবছর যারা গরু কোরবানি দেন, তাদেরকে মাঝেমধ্যে ছাগল কোরবানি দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন আলেমরা। অথবা এমন জায়গায় গিয়ে কোরবানি করতে বলেন, যেখানে অন্য কেউ জানার সুযোগ না থাকে। এতে ইখলাস বা নিষ্ঠার ব্যাপারটি সঠিক থাকে।

কসাইকে গোশত দেওয়া: আরেকটি বড় ভুল হলো—কসাইকে আমরা অনেক সময় কোরবানির গোশত দিয়ে থাকি। অনেক অঞ্চলে দেখা যায়, জবাইকারীকে পশুর মাথা বা কিছু অংশ দিয়ে দেওয়া হয়। এটি সম্পূর্ণ নাজায়েজ একটি কাজ। নবী কারিম (স.) এ ভুল থেকে পরিষ্কারভাবে নিষেধ করেছেন। কসাইকে কোরবানির গোশত দেওয়া মানে পারিশ্রমিক দেওয়া।

কোরবানির পশু বিক্রি করা জায়েজ নেই। কাউকে পারিশ্রমিক হিসেবে দিলে সেটি বিক্রি করারই নামান্তর। সুতরাং এই ভুল থেকে বিরত থাকা জরুরি। এ বিষয়ে ফতোয়ার কিতাবাদিতে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, ‘পশু জবাই করে পারিশ্রমিক দেওয়া-নেওয়া জায়েজ, তবে কোরবানির পশুর কোনো কিছু পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া যাবে না। (কিফায়াতুল মুফতি: ৮/২৬৫)। ‘অবশ্য ঘরের অন্যান্য সদস্যদের মতো কাজের লোকদেরকে গোশত খাওয়ানো যাবে।’ (আহকামুল কুরআন জাসসাস: ৩/২৩৭; বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২২৪; আলবাহরুর রায়েক: ৮/৩২৬)

অনেক সময় কসাই অল্প টাকায়ও রাজি হয়ে যায়, কারণ সে জানে যে, কিছু মাংস পেলে তার অনেক লাভ হয়ে যাবে। তাই কোরবানিদাতাকে কসাই ঠিক করার আগেই তাকে জানিয়ে দেওয়া উচিত যে, তুমি কোনো গোশত পাবে না। তোমাকে শুধু টাকাই দেওয়া হবে। এতে সে রাজি না হলে তাকে দিয়ে কাজ করানো উচিত হবে না। তবে কসাই যদি দরিদ্র হয়ে থাকেন, অন্য দরিদ্রদের যেভাবে গোশত দিচ্ছেন, তাকেও সেভাবে দিতে পারেন। তবে তা কাজের শর্ত হতে পারবে না।

ভুল নিয়মে জবাই: জবাইয়ের সময় পশুর চারটি রগের তিনটি কাটা নিশ্চিত করতে হবে। অনেক সময় জবাইকারী একটুখানি ছুরি চালানোর পর ছোট ছুরি দিয়ে পশুর গলায় জোরে আঘাত করেন, যা সম্পূর্ণ নাজায়েজ ও গর্হিত কাজ। এতে পশু জবাই হলো না বরং আঘাতে হত্যা করা হলো। চিকিৎসা বিজ্ঞানের আলোকে পশু জবাইয়ের যে স্থানে তীক্ষ্ণ ছুরি দিয়ে আঘাত করা হয়, সেটি মূলত- ‘মেরুরজ্জু বা স্পাইনাল কর্ড’ এর অংশ। ছুড়ির আঘাতে পশুর স্পাইনাল কর্ড বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেই পশুর দেহ থেকে মস্তিষ্কের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে পশুটি হার্ট অ্যাটাক করে এবং মারা যায়। তখন এটি জবাই সাব্যস্ত না হয়ে হত্যায় পরিগণিত হয়।

আরও বড় বিপদ হচ্ছে, স্পাইনাল কর্ডের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে সব রক্ত পশুর দেহ থেকে বের হতে পারে না। পশুর দেহের মাংশপেশিতেই রক্ত জমাট বেঁধে যায়। শিরা উপসিরা থেকে পুরোপুরি রক্ত বের হতে না পারলে গোশত দূষিত হয়ে যায়। কোরবানি করা পশুর এ দূষিত গোশত খেলে অনেক সময় ক্যান্সার, এইচবিএএসসহ অন্তত ১৮ ধরনের জটিল রোগের সৃষ্টি হওয়ার প্রবল আশঙ্কা থাকে। তাই সঠিক পদ্ধতিতে কোরবানি ও স্বাভাবিক জবাই সম্পন্ন করা জরুরি। এজন্য প্রাণীর চারটি রগের মধ্যে কমপক্ষে তিনটি রগ কাটা নিশ্চিত করতে হবে। চারটি রগ হলো- শ্বাসনালী, খাদ্যনালী ও দুটি রক্তনালী বা শাহরগ।

বর্জ্য যত্রতত্র ফেলে রাখা: এই ভুলটা প্রায় সবাই করে থাকেন। কোরবানির পর পশুর রক্ত, বর্জ্য, বিভিন্ন খণ্ডিত অংশ যত্রতত্র ফেলে দেওয়া কঠিন গুনাহের কাজ। এতে মানুষকে কষ্ট দেওয়া হয়। আর মহান আল্লাহ মানুষকে কষ্ট দেওয়া খুবই অপছন্দ করেন। মনে রাখতে হবে, বর্জ্যের কারণে পচা দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়, নালা নর্দমায় ফেলে দিলেও সমান কষ্ট।

এতে মশা ও রোগজীবাণু বিস্তারলাভ করে। বৃষ্টিপাত বা বন্যা হলে তো ওই বর্জ্যের কারণে মানুষের কষ্টের শেষ থাকে না। তাই বর্জ্য অপসারণে নিজের দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে পালন করতে হবে। যারা শহরে বাস করেন, তারা সিটি করপোরেশনের নির্দেশনা মেনে চলবেন এবং গ্রামাঞ্চলের মানুষ পরিত্যক্ত স্থানে মাটির নিচে বর্জ্য ভালোভাবে চাপা দেবেন, যাতে বাইরে কোনোভাবেই গন্ধ বা রক্তের কোনো চিহ্ন প্রকাশিত না হয়। মনে রাখতে হবে, রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে দেওয়া ঈমানের দাবি।

রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা রাস্তার ওপর বসা ছেড়ে দাও। লোকজন বলল, এ ছাড়া আমাদের কোনো উপায় নেই। কেননা এটাই আমাদের ওঠা-বসার জায়গা এবং আমরা এখানেই কথাবার্তা বলে থাকি। নবী (সা.) বলেন, যদি তোমাদের সেখানে বসতেই হয়, তবে রাস্তার হক আদায় করবে। তারা বলল, রাস্তার হক কী? তিনি বললেন, দৃষ্টি অবনত রাখা, কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকা, সালামের জবাব দেওয়া, সৎকাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করা’ (বুখারি : ২৪৬৫)।

আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘ঈমানের সত্তরের বেশি শাখা-প্রশাখা রয়েছে। তন্মধ্যে সর্বোত্তম শাখা হলো ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলা, আর সর্বনিম্ন শাখা হলো রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে ফেলা’ (ইবনে মাজাহ : ৫৭)। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে কোরবানির সময় উপরোক্ত ভুলগুলো থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে