সাঁথিয়ায় জাল দলিল তৈরী করে জমি দখলের অপচেষ্টা

প্রকাশিত: জুলাই ২, ২০২২; সময়: ৪:১৭ অপরাহ্ণ |
সাঁথিয়ায় জাল দলিল তৈরী করে জমি দখলের অপচেষ্টা

নিজস্ব প্রতিবেদক, পাবনা : পাবনার সাঁথিয়ায় জাল দলিলসহ ভুয়া কাগজপত্র তৈরী ও ভূমি কর্মকর্তার সিল-স্বাক্ষর নকল করে প্রায় ৫২ বিঘা জমি দখলের অপচেষ্টার অভিযোগ উঠেছে। বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের যুগ্ম পরিচালক মনছুর আলম ও তার ভাইয়ের জমি জালিয়াতির রেশ কাটতে না কাটতেই এই এলাকায় আরেকটা জালিয়াতি চক্রের সন্ধান সাথে জড়িত ভূমি অফিসের কর্মচারীও।

বিষয়টি তদন্ত করে পুরো জালিয়াতির ঘটনার সত্যতাও পেয়েছেন ভূমি কর্মকর্তা। তদন্ত প্রতিবেদনে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ারও সুপারিশ করেছেন তিনি। পরে এ ঘটনায় মামলা দায়ের করা হলে চক্রের মুল হোতা আবুল বাশারকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

অভিযোগে জানা গেছে, সাঁথিয়া উপজেলার গৌরিগ্রাম মৌজার ১৭.৩৬ একর জমি আর এস ১৬৩৪, ১৬৩৫ ১৬৩৬ খতিয়ানের মালিক মাধব চন্দ্র চৌধুরীর ছেলে রাজেন্দ্র কুমার। তিনি দেশ স্বাধীনের আগে চলে যান ভারতে। পরবর্তীতে ওই জমি আর এস এবং এস এ রাজেন্দ্র কুমারের নামে চূড়ান্তভাবে রেকডভুর্ক্ত হয়।

২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে উপজেলা ভূমি অফিসের কিছু কর্মচারীর যোগসাজশে জাল দলিল তৈরী এবং ভূমি কর্মকর্তার সিল স্বাক্ষর নকল করে উপজেলা ভূমি অফিসের মিস মোকদ্দমার ভুয়া রায় তৈরী করে একটি চক্র। এরপর ওই বছরের অক্টোবর মাসে খাজনা পরিশোধ করে। যার প্রেক্ষিতে জমি খারিজ করা হয়।

কাগজপত্রে মিসকেসের রায় দেখানো হয়েছে ২০১৭ সালে। অথচ ২০১৭ সালে সাঁথিয়া উপজেলা ভূমি অফিসে মিস মোকদ্দমার এমন কোনো রায় হয়নি। ওই চক্রের দাবিকৃত ১৯৬১ ও ১৯৭৩ সালের দুইটা দলিল জেলা রেজিস্টার অফিসেও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসা ওই চক্রের কয়েকজন হলেন, সাঁথিয়া উপজেলার ইকরজানা গ্রামের আব্দুল লতিফ, বিলমহিষারচর গ্রামের আলাউদ্দিন প্রামানিক, সোনতলা গ্রামের গোলাম মোস্তফা, ঘুঘুদহ গ্রামের তাহিরন নেছা ও পাবনা পৌর সদরের কৃষ্ণপুর মহল্লার আমিরুল ইসলাম বাবু। পরবর্তীতে তারা আবুল বাশার, আব্দুল হাকিম সহ বেশকিছু মানুষের কাছে জমি বিক্রি করেছেন। কিন্তু ওই জমি তাদের দখলে নেই। স্থানীয় ভূমিহীন মানুষ বসবাস ও চাষাবাদ করছেন দীর্ঘদিন ধরে।

পরবর্তীতে জমি খারিজ করে নেয়ার বিষয়টি জানতে পেরে একই জমির মালিক দাবিদার সাতজন ব্যক্তি। তারা ভূমি অফিসে ওই খারিজ বাতিলের আবেদন করেন। আবেদনের প্রেক্ষিতে তদন্তে নামেন উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) মনিরুজ্জামান। তিনি মিস মোকদ্দমার নথি, ইউনিয়ন ভূমি সহকারি কর্মকর্তা ও সার্ভেয়ারের প্রতিবেদন, জমির দলিল, খারিজের কাগজপত্র সহ সবকিছু যাচাই বাছাই করে নিশ্চিত হন ১৭.৩৬ একর (৫২ বিঘা) জমি ওই চক্রটি জাল দলিল, মিস মোকদ্দমার ভুয়া রায় তৈরী ও তৎকালীন ভূমি কর্মকর্তা আরাফাত রহমানের সিল স্বাক্ষর নকল করে খারিজ করে নিয়েছেন। তৎকালীন ইউনিয়ন ভূমি সহকারি কর্মকর্তা সেটেলমেন্ট অফিসের কর্মচারীদের সাথে যোগসাজশ করে জমির মুল মালিক রাজেন্দ্র চৌধুরীর নামীয় খতিয়ানের মুল পৃষ্ঠা সরিয়ে ওই চক্রের নামে আর এস ১৬৩৪, ১৬৩৫ ও ১৬৩৬ এই তিনটি খতিয়ান বিভিন্ন রেকর্ড ভলিয়মে অবৈধভাবে সংযোজন করেছেন।

কিন্তু তারা জজকোর্ট পাবনা অফিসের রেকর্ড ভলিয়মে অবৈধভাবে সংযোজন করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। এছাড়া মিস মোকদ্দমা নং ৪৪২(ক)/২০১৬-১৭ এর ভুয়া আদেশও তৈরী করেছিলেন। অপরদিকে, ভূমি উন্নয়ন কর গ্রহনের আদেশ ২০১৭ সালে দেখানো হলেও চার বছর পর ২০২১ সালে ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করা হয়েছে। সবমিলিয়ে জালিয়াতি সন্দেহাতীতভাবে নিশ্চিত হওয়ার পর গত ৬ জুন ওই জমির খারিজ বাতিল করেন ভূমি কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান।

এ বিষয়ে অভিযুক্ত ঘুঘুদহ গ্রামের তহির নেছার ছেলে আবুল বাশার বলেন, আমার বাপ দাদা থেকে জমি ভোগদখল করে আসছি। তাদের দলিল মোতাবেক খাজনা খারিজ হয়েছে। আমার মায়ের কাছ থেকে আমি রেজিস্ট্রি করে নিয়ে খারিজ করেছি। এখন এসি ল্যান্ড খারিজ বাতিল করেছেন। আমরা আদালতে মামলা করেছি। সেটি আদালতে বিচারাধীন আছে। ২০২১ সালে আমার জমি কেনাও আছে। জমির দলিল তো এসি ল্যান্ড বাতিল বা ভুয়া প্রমাণ করতে পারেন নাই। এখন আদালতে মামলা চলছে, সেখানেই প্রমাণিত হবে।

আরেক অভিযুক্ত ইকরজানা গ্রামের আব্দুল লতিফ বলেন, আমি মূর্খ মানুষ, সইটাও ঠিকমতো করতে পারি না। সোনাতলা গ্রামের গোলাম মোস্তফা আমাকে জমি দেবে বলে আমার আইডি কার্ড, ছবি নিলো। ৬ বিঘা জমি আমার নামে দেবে বলে ৩ লাখ টাকাও নিছে। আমি তো জানিনা যে সে এরকম ভুয়া কাগজপত্র তৈরী করে একাজ করছে। এত ঝামেলা জানলে তো আমি জমি নিতাম না। এখন আইনে যেটা হয় সেটা মেনে নিবো।

উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) মনিরুজ্জামান বলেন, ২০১৭ সালের মিস মোকদ্দমা ৪৪২ (ক) এর প্রেক্ষিতে ১৭.৩৬ একর জমি নামজারিগুলো অনুমোদিত হয়েছিল, সেটি বিবাদিগণ ভূমি অফিসের কিছু কর্মচারীর যোগসাজশে জালিয়াতি করে নিয়েছিলেন। উপজেলা ভূমি অফিস থেকে মিস মোকদ্দমার এই রায় জালিয়াতি ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তৈরী করে ৮ সেপ্টেম্বর খাজনা পরিশোধ করে এবং ৫ অক্টোবর খারিজ হয়।

এছাড়া দাখিলকৃত আদেশের চার বছর পর ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করা, জমিগুলো তাদের দখলে না থাকা, খতিয়ান বহির রেকর্ড ভলিয়মে অবৈধভাবে বানোয়াট ১৬৩৬ নং খতিয়ান সংযুক্ত করার অপচেষ্টা করা, মিস মোকদ্দমার রায় জালিয়াতি করে সরকারের স্বার্থ ক্ষুন্ন করেছেন তারা।

সবকিছু আমাদের কাছে ভুয়া ও জালিয়াতি প্রমাণিত হওয়ার পর তাদের নামজারি বাতিল করা হয়েছে। সেইসাথে ওই জমি খাসকরণের ব্যবস্থা গ্রহণ ও পরবর্তীতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের অন্তর্গত ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের অনুকূলে বরাদ্দ প্রদানের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সকলকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) মনিরুজ্জামান আরও বলেন, বিবাদী চক্রের দাখিলকৃত খ তফসিলের মিস মোকদ্দমার আদেশ জালিয়াতি করে সরকারি স্বার্থের ক্ষতিসাধন করায় তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট ইউএলও ও বিজ্ঞ সরকারি কৌশুলীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সেইসাথে এই জালিয়াতি কাজে ভূমি অফিসের যেসকল কর্মচারী জড়িত ছিল, তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসক বরাবর সুপারিশ প্রেরণ করার জন্য বলা হয়েছে।

এদিকে, জালিয়াতি চক্রের ৬ জনকে আসামী করে গত ৩০ জুন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভুমি) মনিরুজ্জামান সাঁথিয়া থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন। মামালায় মুল হোতা ঘুঘুদহ গ্রামের আব্দুল জব্বার প্রামানিকের ছেলে আবুল বাসারকে গত বৃহস্পতিবার (৩০ জুন) গ্রেফতার করেছে কারাগারে পাঠিয়েছে পুলিশ। গ্রেপ্তার এড়াতে বাকিরা গা ঢাকা দিয়েছে বলে জানা গেছে।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে