‘মামলা তুলে নেব ভাই, তুই দরজা ভাঙিস না’

প্রকাশিত: জুন ১১, ২০২২; সময়: ১০:০৫ পূর্বাহ্ণ |
‘মামলা তুলে নেব ভাই, তুই দরজা ভাঙিস না’

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : ফরিদপুরের সালথায় সাবেক এক ইউপি সদস্য ও তার ভাইয়ের বাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় ঘরের ভেতর থেকে দরজার ফুটো দিয়ে করা একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। ওই ভিডিওতে হামলাকারীদের হামলার চিত্র ও হামলার শিকার এক নারীর কথোপকথন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।

হামলায় সাবেক ইউপি সদস্য মতিয়ার রহমানসহ তার পরিবারের আরও কয়েকজন আহত হয়েছেন। তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

গত বৃহস্পতিবার (৯ জুন) বিকেল ৪টার দিকে উপজেলার মাঝারদিয়া ইউনিয়নের কুমারপট্টি গ্রামের বাসিন্দা এক নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য মো. মতিয়ার রহমান মাতব্বর ও তার ভাই মো. হায়াত আলী মাতুব্ব‌রের বাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটে। অভিযোগ রয়েছে, এ হামলা চালিয়েছে তার (মতিয়ার রহমান) প্রতিপক্ষ এক নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান ইউপি সদস্য মো. মোক্তার হোসেন ও তার সমর্থকরা।

এ হামলার ২ মিনিট ২৩ সেকেন্ডে যে ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে সেখানে দেখা যায়, হামলার সময় ঘরের মধ্যে আতঙ্কিত হয়ে আটকে থাকা এক নারীকে বারবার হামলাকারীদের পা ধরে ক্ষমা চাচ্ছেন।

ভিডিওতে আরও দেখা যায়, হামলাকারীরা হাতে লাঠি নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করে প্রথমে ঘরের দরজা ভাঙার চেষ্টা করে। তখন ঘরের মধ্যে আটকে থাকা এক নারী চিৎকার করে বিপদ থেকে মুক্তির দোয়া পড়তে থাকেন। পরে ওই নারী সজিব নামে এক হামলাকারীর উদ্দেশে বারবার চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘ও সজিব তোর পায়ে ধরি দরজা ভাঙিস না, ভাই। সর ভাই, যা ভাই, তোর পায়ে ধরি ভাই’। উত্তরে হামলাকারী সজিব বলেন, ‘মামলা কবে উঠাবি? কবে উঠাবি বল, আগামী সোমবার মামলা উঠাবি’। এরপর ওই নারী বলেন, ‘সোমবারেই মামলা উঠিয়ে নিতে বলব ভাই, তুই যা’। এ কথাবার্তার পরও হামলাকারীরা দরজা ভেঙে ঘরের ভেতর ঢুকে আসবাব ভাঙচুর করে।

এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, গত জানুয়ারিতে গ্রাম্য দলাদলির জের ধরে মোক্তার হোসেনের সমর্থকরা মতিয়ার রহমানের বাড়িতে হামলা চালায়। এ ঘটনায় মতিয়ার বাদী হয়ে দ্রুত বিচার আইনে মোক্তার হোসেনের চার ভাইসহ মোট ৩৩ জনের নাম উল্লেখ করে একটি মামলাটি দায়ের করেন।

এলাকার আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মতিয়ার ও মোক্তারের মধ্যে দীর্ঘ দিন ধরে বিরোধ চলছিল। মতিয়ারকে মাঝারদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সাহেদুজ্জামান এবং একই ইউনিয়ন পরিষদের আরেক সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি হামিদুর রহমান মোক্তারকে মদদ দেন বলে এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে।

দুই মাস আগে মোক্তার ও মতিয়ারের মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল ওদুদ, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি দেলোয়ার হোসেন, সাধারণ সম্পাদক ফারুকুজ্জামান এক বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে মোক্তারকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয় এবং এর বিনিময়ে মতিয়ারকে মোক্তারের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার করতে বলা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে মোক্তার জরিমানার টাকা দেননি এবং মাতিয়ার মামলাও প্রত্যাহার করেননি। এই বিরোধের জের ধরে গত বৃহস্পতিবার (৯ জুন) ওই মামলার বাদী মতিয়ার ও তার ভাই হায়াত আলীর বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর করা হয়।

সাবেক ইউপি সদস্য মতিউর রহমান মাতুব্বর বলেন, গত জানুয়ারি মাসে আমার বাড়িতে হামলা চালায় মোক্তার হোসেন। ওই ঘটনায় ইউপি সদস্য মোক্তার হোসেনসহ তার চার ভাই ও তাদের দলের লোকজনের নামে মামলা দায়ের করি। যা বর্তমানে আদালতে বিচারাধীন। মামলাটি তুলে নিতে আসামিরা দীর্ঘদিন যাবত বিভিন্নভাবে হুমকি দিয়ে আসছিল।

তিনি বলেন, গতকাল বৃহস্পতিবার বিকাল ৩টার দিকে আমি এলাকার বিনোকদিয়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার পথে কাজী কামরুজ্জামানের বাড়ির সামনে পৌঁছালে মোক্তার হোসেন, শাহ আলম, সজীব ও মাহমুদসহ ১০-১২ জন পথ আটকে দিয়ে মামলা তুলে নিতে হুমকি দেয়। এসময় শাহ আলম হেলমেট দিয়ে আমাকে মারতে থাকে। আমার চিৎকার শুনে পাশের বাড়ির মমতাজ বেগম ও এক ভ্যানচালক এসে উদ্ধার করে। এর কিছুক্ষণ পর শাহ আলমের নেতৃত্বে ২০-২৫ জন লোক এসে আমার বাড়ি ও আমার ভাইয়ের বাড়ি-ঘরে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট করে। এসময় আমার স্ত্রী ও ভাবিকে মারপিট করে আহত করে।

হায়াত আলী মাতুব্বরের মেয়ে আমেনা আক্তার বলেন, ২০/২৫ জন লোক এসে আমাদের বাড়িতে হামলা চালায়। এসময় শাহ আলম, মোক্তার হোসেন ও সজীব আমাদের ঘরে হামলা করে আর বলতে থাকে, সোমবারের মধ্যে মামলা তুলে না নিলে তোদের মেরে ফেলব।

হায়াত আলী মাতুব্বর বলেন, আমার বাড়ির উপর একটি বরফকল কারখানা রয়েছে। ওই বরফকলে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে বর্তমান ইউপি সদস্যসহ তার লোকজন। এছাড়া বসতঘরেও হামলা চালিয়ে মালামাল লুটপাট করে নিয়ে যায়।

এ ঘটনায় মতিয়ার রহমান তার স্ত্রী জেসমিন ও ভায়ের স্ত্রী রুনা বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ফরিদপুরে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

তবে হামলার ঘটনা অস্বীকার করে ইউপি সদস্য মোক্তার হোসেন বলেন, আমরা হামলা করিনি। মতিয়ার রহমান আমার এক ভাইকে মারপিট করে তার চোখ নষ্ট করে দিয়েছে।

তিনি বলেন, আমাকে নতুন করে মামলা দিয়ে হয়রানি করার জন্য এ হামলায় আমি জড়িত বলে দাবি করা হচ্ছে। ভিডিওর বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওটা আগের ভিডিও।

সালথা থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আওলাদ হোসেন বলেন, মামলা তুলে না নেওয়ায় মতিয়ার মাতুব্বরের বাড়িতে হামলা চালায় প্রতিপক্ষের লোকজন। এ সময় তারা একটি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেয়। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। এ ঘটনায় একজনকে আটক করা হয়েছে। বাকিদের আইনের আওতায় আনা হবে।

ফরিদপুরের সহকারী পুলিশ সুপার (নগরকান্দা সার্কেল) সুমিনুর রহমান বলেন, বর্তমান ও সাবেক দুই ইউপি সদস্যের দ্বন্দ্বের জেরে এ হামলার ঘটনা ঘটেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার মামলা প্রত্যাহারের জন্য প্রথমে রাস্তায় মতিয়ারকে মারপিট করে আহত করা হয়। পরে ২০/২৫ দলের একটি বাড়িতে হামলা চালায়। মোক্তার হোসেনসহ এ ঘটনায় যারা জড়িত তাদের গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান চলছে।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে