দেশে প্রতি বছর দূষণে মারা যায় ২ লাখ মানুষ

প্রকাশিত: মে ২০, ২০২২; সময়: ১১:৫৬ অপরাহ্ণ |
দেশে প্রতি বছর দূষণে মারা যায় ২ লাখ মানুষ

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : বিষাক্ত বায়ু ও বর্জ্যের দূষণের কারণে দেশে প্রতি বছর ২ লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। দূষণজনিত এ মৃত্যুতে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থায় ষষ্ঠ। এ তালিকায় প্রথম অবস্থানে আছে প্রতিবেশী দেশ ভারত।

স্থানীয় সময় গত ১৮ মে যুক্তরাজ্যভিত্তিক স্বাস্থ্যবিষয়ক সাময়িকী ল্যানসেট প্লানেটারি হেলথ জার্নালে ‘পল্যুশন অ্যান্ড হেলথ: আ প্রোগ্রেস আপডেট’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। গবেষণাটি সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কোঅপারেশন (এসডিসি) ও মিনিস্ট্রি অব এনভায়রনমেন্ট অব সুইডেন এবং গ্লোবাল অ্যালায়েন্স অন হেল্‌থ অ্যান্ড পলিউশন (গ্যাপ) ও পিওর আর্থ-এর সহযোগিতায় করা হয়েছে।

এ গবেষণা প্রতিবেদনে মাটি, পানি ও বায়ু দূষণের কারণে মানবসমাজ ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ক্ষতি এবং স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাবগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। ‘দ্য ল্যানসেট কমিশন অন পলিউশন অ্যান্ড হেলথ’ শীর্ষক একই ধরনের একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৭ সালে। নতুন প্রতিবেদনটি মূলত সেই প্রতিবেদনেরই একটি পরিমার্জিত সংস্করণ। যেখানে বলা হয়, এ রিপোর্টটি প্রথম প্রকাশিত হওয়ার পর মাঝের এ কয়েক বছরে পরিবেশ দূষণের কারণে অকালে ঝরে গেছে বিশ্বের ৪ কোটি ৫০ লাখ মানুষের প্রাণ!

গবেষকেরা দেখতে পান, পরিবেশ দূষণের কারণে ২০১৯ সালে বিশ্বের প্রায় ৯০ লাখ মানুষ (প্রতি ৬ জনে ১ জন) প্রাণ হারিয়েছেন। বাংলাদেশও দূষণজনিত মৃত্যুর তালিকার উপরের দিকেই আছে, যা দেশটির জন্য জলবায়ু হুমকির পাশাপাশি নতুন হুমকি সৃষ্টি করেছে। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বজুড়ে তীব্র দারিদ্র্যতার কারণে সৃষ্ট দূষণে মৃত্যুর সংখ্যা কমলে সেই অর্জন ম্লান হয়ে গেছে শিল্প দূষণজনিত কারণে মৃত্যু বৃদ্ধি পাওয়ায়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বিভিন্ন প্রকার দূষণজনিত কারণে বাংলাদেশে ২০১৯ সালে ২ লাখ ১৫ হাজার ৮২৪ জনের মৃত্যু হয়। এরমধ্যে শুধু বায়ু দূষণের কারণেই সর্বাধিক ১ লাখ ৭৩ হাজার ৫১৫ জনের মৃত্যু হয়। দূষণজনিত মৃত্যুর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যুর কারণ পানি দূষণ। প্রতি বছর পানি দূষণে ৩০ হাজার ৮৭৪ জনের প্রাণহানি হয়। এ ছাড়া অন্যান্য দূষণজনিত মৃত্যুর মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে সিসা দূষণ। সিসা দূষণের কারণে দেশে ৩০ হাজার ৭৭৭ জনের মৃত্যু হয়। এ ছাড়া পেশাগত দূষণে মারা যান ১০ হাজার ২৮৯ জন।

গবেষকদের মতে, দূষণে মৃত্যুতে বিশ্বে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ ভারত। দেশটিতে ২০১৯ সালে ২৩ লাখ ৫৭ হাজার ২৬৭ জনের মৃত্যু হয়। একই সময়ে চীনে মারা যান ২১ লাখ ৭৭ হাজার ৪৬০ জন, যা বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।

অন্যদিকে একই কারণে ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৭৬০ জনের মৃত্যু নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়া। চতুর্থ অবস্থানে থাকা পাকিস্তানে মারা যান ৩ লাখ ৮৮ হাজার মানুষ এবং ২ লাখ ৬৩ হাজার ৩৪৪ জন মারা যাওয়া ইন্দোনেশিয়া রয়েছে পঞ্চম অবস্থানে। এর ঠিক পরেই বাংলাদেশের অবস্থান।

দূষণজনিত মৃত্যুর বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে গবেষকরা দেখতে পান, প্রতি বছর দূষণজনিত কারণে যে ৯০ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে তার প্রায় ৭৫ শতাংশই বায়ু দূষণের কারণে। পারিপার্শ্বিক বায়ু দূষণের কারণে ২০১৯ সালে ৪৫ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে, ২০১৫ সালে যা ছিল ৪২ লাখ এবং ২০০০ সালে ছিল ২৯ লাখ।

বিপজ্জনক রাসায়নিক দূষণের কারণে ২০০০ সালে মৃত্যুর পরিমাণ ছিল ৯ লাখ, সেই সংখ্যা ২০১৫ সালে বৃদ্ধি পেয়ে ১৭ লাখ এবং ২০১৯ সালে ১৮ লাখে এসে দাঁড়িয়েছে; সাথে সিসা দূষণের কারণেই কেবল ৯ লাখ মানুষ অকালে মারা গেছে। সব মিলিয়ে, এই নিত্যনতুন ধরনের দূষণসমূহ গত দুই দশকে ৬৬% বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০০ সালের আনুমানিক ৩৮ লাখ মৃত্যু থেকে যা ২০১৯ সালে ৬৩ লাখ মৃত্যুতে এসে ঠেকেছে।

ল্যানসেট কমিশনের তথ্য অনুসারে, দূষণের কারণে অস্বাভাবিক মাত্রার মৃত্যু আমাদের আর্থিক ক্ষতির দিকেও ঠেলে দিচ্ছে। ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাপী ৪.৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের ক্ষতি হয়েছে, যা বৈশ্বিক অর্থমূল্যের ৬.২%। গবেষণায় আরও দেখা গেছে, ৯২% দূষণজনিত মৃত্যু এবং দূষণের কারণে আর্থিক ক্ষতির বোঝা সবচেয়ে বেশি হচ্ছে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর ঘাড়ে, যা প্রচণ্ড অসমতার সৃষ্টি করছে।

পিওর আর্থ নামে দূষণ নিয়ে কাজ করা অলাভজনক সংগঠনের প্রধান ও গবেষণার প্রধান লেখক রিচার্ড ফুলার বলেন, জনস্বাস্থ্যের ওপর দূষণ ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলে, আর এ মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাবে বোঝা নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলো ধুঁকে ধুঁকে বয়ে বেড়াচ্ছে। এতসব মারাত্মক স্বাস্থ্যগত, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন মহলের দূষণ নিরসনের দিকে সে রকম কোনো নজর নেই।

তিনি আরও বলেন, ২০১৫ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত দূষণ প্রতিরোধ করে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় অর্থ বরাদ্দ ও নজরদারি খুব সামান্যই বেড়েছে, নানা গবেষণায় দূষণের কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকিও এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে শঙ্কা বৃদ্ধি বিষয় উঠে আসা সত্ত্বেও তা নিরসনে যথেষ্ট উদ্যোগের অভাব আছে।

এদিকে গবেষকরা দূষণজনিত অকাল মৃত্যু ঠেকাতে নীতি নির্ধারকদের প্রতি ৮টি পরামর্শও দিয়েছেন। এরমধ্যে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে এবং জাতীয় পর্যায়ের সরকারদের ‘পরিবেশ দূষণ’ নিরসনের বিষয়টিতে বিশেষভাবে নজর দেওয়া, জলবায়ু পরিবর্তন ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করার পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে বায়ু, সিসা ও রাসায়নিক দূষণ নিরসনের ওপর জোর দেওয়া এবং অতি দ্রুত জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে বিশুদ্ধ, নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে স্থানান্তরের ওপরও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণের জন্য সরকারি-বেসরকারি দাতা সংস্থাদের পরিবেশ দূষণ ব্যবস্থাপনার জন্য অর্থ বরাদ্দ করার সুপারিশও করা হয়েছে।

ল্যানসেটের প্রতিবেদনে অন্যান্য দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশে দূষণের যে ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে সে প্রসঙ্গে শুক্রবার (২০ মে) রাতে সময় সংবাদের কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতাত্ত্বিক বিজ্ঞানের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এম আজিজ হাসানের সঙ্গে। তিনি দীর্ঘদিন সিসা দূষণের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করছেন।

এ বিষয়ে তিনি বলেন, দেশে দিন দিন পরিবেশ দূষণ বাড়ছে এতে সন্দেহের অবকাশ নেই। আর দূষণ বাড়লে সেটি মানুষ ও জীববৈচিত্র্য বা প্রাণিজগতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে সেটাই স্বাভাবিক। বায়ু, মাটি, পানি ইত্যাদির দূষণ কোনোভাবেই স্বাস্থ্যকর সুন্দর জীবনযাপনের বিকল্প নয়। কেননা এসব দূষণ আমাদের পরিবেশ, শ্বাস-প্রশ্বাস, খাদ্য এবং সবশেষে স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে, ডেকে আনে নানা ব্যাধি।

তিনি বলেন, সিসার দূষণ পরিবেশ দূষিত হওয়ার অন্যতম অনুঘটক। দেশের বিভিন্ন কারণে সিসা দূষণের মাত্রা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ধরনের দূষণ কবলিত এলাকার মানুষ ও জীববৈচিত্র্যকে যে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে সেটি অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই।

স্বাস্থ্যকর বাসযোগ্য পরিবেশ এবং সুন্দর আগামীর জন্য শুধু সিসা নয়, সব ধরনের দূষণই নিরাপদ মাত্রায় নামিয়ে আনার বিকল্প নেই বলেও মনে করেন এ গবেষক।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে