দুঃসহ নক্ষত্রপতন

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৬, ২০২১; সময়: ২:১২ পূর্বাহ্ণ |
দুঃসহ নক্ষত্রপতন

ফয়জুল লতিফ চৌধুরী : হাসান আজিজুল হক প্রয়াত। ১৫ নভেম্বর সোমবার দিবাগত রাত সোয়া ৯টায় রাজশাহীতে নিজ গৃহে তাঁর মৃত্যু হলো। জন্ম তাঁর ১৯৩৯ সালে; চলে যাওয়ার সময় বয়স হয়েছিল ৮২। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন তিনি পরিণত বয়সে। কিন্তু তাঁর মৃত্যুতে বাংলা ভাষার এমন একজন কথাসাহিত্যিকের মৃত্যু হলো যিনি বাংলা ছোটগল্পের নতুন মানদণ্ড নিরূপণ করে গেছেন।

হাসান ভাই ষাটের গোড়া থেকে ব্যতিক্রমী গদ্যভঙ্গীর জন্য পাঠকের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিলেন। যত বৎসর গড়িয়েছে, তার বিশিষ্টতা সম্পর্কে বাঙ্গালী পাঠক-সমালোচক ক্রমান্বয়ে নিশ্চিত হয়েছেন। তৃতীয় সহস্রাব্দ শুরুর অনেক আগেই তিনি দুই বাংলা মিলিয়ে বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান গদ্যশিল্পীর পরিচয়ে চিহ্নিত হয়েছেন।

তাঁর মৃত্যুর সংবাদ এসেছে পূর্ব ও পশ্চিম উভয় বাংলার অসংখ্য অনুরাগী পাঠককে শোকস্তব্ধ করে। এই শোক দীর্ঘস্থায়ী হবে, কারণ তাঁর ঐতিহ্য বহন করবে এরকম উত্তরপ্রজন্ম ইতোমধ্যে আর্বিভুত হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয় না।

তাঁর প্রথম দুটি গল্পগ্রন্থ ‘সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য’ এবং ‘আত্মজা ও একটি কবরী গাছ’ প্রকাশিত হয়েছিল যথাক্রমে ১৯৬৪ ও ১৯৬৭ সালে। অনতিবিলম্বে, ১৯৭০-এই, তিনি বাংলা একাডেমী পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন।

ভারতের আনন্দ পুরস্কার পেয়েছিলেন কিছু দিন আগে, ২০০৮-এ, যখন জীবনের শেষ গল্পটি লিখে ফেলেছেন। তিনি প্রমাণ করে গেছেন কথাসাহিত্যও কবিতার মতো নিরেট ও নিটোল হয়ে উঠতে পারে। তাঁর রচনা এক ধ্যানীর চিন্তা ও চেতনার ফসল যাতে তার আখ্যানে অবিচ্ছিন্নভাবে জড়িয়ে যায় নিসর্গ ও মানুষের মনস্তত্ব।

অন্যদিকে অনপনেয় সামাজিক দায়বদ্ধতা তাঁর অনেক গল্পের অভিমুখ নির্বাচন করে দিয়েছে। তিনি বলেছিলেন, “আমি যাদের কথা বলতে চাই তারা হচ্ছে আমাদের দেশের শতকরা ৯৫ ভাগ। আমার রাজনৈতিক বিশ্বাসটা তাহলে কী? এই ৯৫ ভাগ মানুষকে মুক্ত করতে হবে।

আমার রাগের কারণ কী? আমার ক্রোধের কারণ কী? এই ৯৫ ভাগ মানুষের প্রতিভা ও কর্মশক্তির কোন বিকাশ নেই এই সমাজে। ৯৫ ভাগ মানুষ এদেশে চাপা পড়ে আছে। এত বড় অন্যায় ও অমানবিকতা একজন লেখক যদি অনুধাবন করতে না পারেন তবে তিনি কিসের লেখক?”

আমরা দেখেছি, তাঁর অচঞ্চল অধিক্ষেত্র ছিল সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবিচল অবস্থান। জীবনের সবচেয়ে রূঢ়তম বাস্তবতা ও সমাজজীবনের কুৎসিততম দিকটিও তাঁর লেখায় অবিকল প্রতিফলিত হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বাস্তব নিষ্ঠুরতা ও হাহাকার তীব্র তীক্ষ্ণ শিল্পরূপ লাভ করেছে তাঁর নামহীন গোত্রহীন (১৯৭৪) গ্রন্থটিতে।

এক-একটি গল্পের জন্য হাসান ভাইয়ের দীর্ঘ সময় লেগে যায়। ১৯৬০ সালের ‘শকুন’ থেকে ২০০৮ এ লেখা শেষ গল্পটি লিখতে তার প্রায় ৫০ বছর লেগে যায়। গড়ে বছরে গল্পের সংখ্যা দুটির বেশি হয়ে ওঠে না। দ্রুত পরিবর্তমান সমাজের নতুন নতুন পাপ ও স্খলন বাদ থেকে যায়। কিন্তু সমাজের মূল চিত্রটি তিনি চিহ্নিত করেছেন নির্ভুল গণিতে।

তাঁর পক্ষে ইচ্ছাপূরণের গল্প লেখা সম্ভবপর ছিল না। তাঁর কথাসাহিত্য এক পর্যবেক্ষণশীল সমাজতাত্ত্বিকের শিল্পিত অভিব্যক্তি। তাঁর গল্প একই সঙ্গে গল্প ও বিশ্লেষণ। কিন্তু জীবনানন্দের যেমন, হাসান আজিজুল হকের মানসভূমি কোনো জটিল ঘূর্ণাবর্ত ছিল না।

বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বিশেষ করে ১৯৪৬-৪৭-এর দাঙ্গা ও দেশভাগ, পাকিস্তানী আমলের সামরিক শাসন, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং নবসৃষ্ট বাংলাদেশের পটভূমিতে তাঁর দৃষ্টি ও পর্যবেক্ষণ প্রসারিত ও অনেকাংশে সীমাবদ্ধ। তিনি তাঁদের নিয়ে লিখতে পছন্দ করেছেন সমাজে যারা নামহীন-গোত্রহীন, নিরাশ্রয় ও উদ্বাস্তু । তিনি সৌভাগ্যবান কেননা বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে এমন এক পাঠক শ্রেণীর আবির্ভাব হয়েছিল যারা সেই ক্ষুধাপ্রপীড়িত, সৌভাগ্যবঞ্চিত, সমাজলাঞ্চিত মানুষের হৃদস্পন্দন শুনবার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠেছিল। ফলে সমসাময়িক সাহিত্য মহলে তিনি সমাদর লাভ করেছেন এবং পাঠকের আনুকূল্য লাভ করে কৃতার্থ হয়েছেন।

মৃত্যুর বীভৎস্য তাণ্ডবলীলার বর্ণনা দিয়ে হাসান ভাই লেখেন: “বাড়িটা ততক্ষণে পুড়ে শেষ। ওরা চলে গেছে। বল্লম দিয়ে মাটির সাথে গাঁথা বশিরের সাত বছরের ছেলেটা। ছাব্বিশ বছরের একটি নারীদেহ কালো একখণ্ড পোড়া কাঠের মতো পড়ে আছে ভাঙ্গা দগ্ধ ঘরে। কাঁচা মাংস-পোড়ার উৎকট গন্ধে বাতাস বিষে ভারী।”

যদিও জীবনের একেবারে শুরুতে উপন্যাস লেখার চেষ্টা করেছিলেন এবং জীবনের উপান্তে পুনর্বার ঔপন্যাসিক হওয়ার বাসনাটি তাঁর কাছে যথেষ্ট প্রশ্রয় লাভ করেছে, আনুপূর্ব তিনি ছোটগল্পের চৌহদ্দিতেই স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করেছেন, ছোটগল্প লিখেই তৃপ্ত বোধ করেছেন।

১৯৬৪তে প্রকাশিত ‘সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য’ লিখবার সময় যে ভাষা তিনি ব্যবহার করেছিলেন তার গাঁথুনি ক্রমে আরো সংবদ্ধ, আরো দৃঢ়তা লাভ করেছে, কিন্তু গল্পের মৌল বিষয়আশয়ে কোনো পরিবর্তন আসেনি। প্রেমিককে বলা বাণীর কথা, ‘আমরা সবাই অসুস্থ, আমাদের লোভ করতে নেই, আমাদের কোনো অধিকার নেই জীবনে’। এরকম শূন্যতাবোধে আক্রান্ত মানুষদের জীবনে হাসান আজিজুল হকের আকর্ষণ।

বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে আবির্ভূত এই গদ্যশিল্পী বাংলাদেশের ছোটগল্পের জগতকে সমৃদ্ধ করেছেন তুলনারহিত দাড্যে ও অন্তর্দৃষ্টিতে। বাংলা সাহিত্যিককে তিনি দান করেছেন ছোটগল্পের নতুন রূপবন্ধ ও অনন্যসাধারণ ভাষা। তার শিল্পাভ্যাসে প্রত্যক্ষ হয়েছে বর্ণনার তুমুল সমাচার।

বারোটি গ্রন্থে অন্তর্ভুত ৮৬টি গল্পে তিনি ধারণ করেছেন তাঁর বিশ্ববীক্ষা, যাতে ব্যক্তিমানুষকে চিত্রায়িত করেছেন গভীর সহমর্মিতায় ও আশ্চর্য নৈপুণ্যে। অনেক ক্ষেত্রে চরিত্রচিত্রণের মধ্য দিয়ে তার বর্ণনাপট গল্প হয়ে উঠেছে। সমাজের ব্রাত্য জন, দলিত-মথিত অসহায় মানুষ এবং সম্বলহীনা নারী তাঁর গল্পের আখ্যানে প্রাধান্য লাভ করেছে ধারাবাহিক একসূত্রীতায়। নিঃসহায় মানুষের সঙ্গে সামাজিক ক্ষমতার মিথষ্ক্রিয়া তাঁর গল্পে নানাভাবে চিত্রিত হয়েছে।

দেবেশ রায় তাকে উল্লেখ করেছিলেন ‘পরম সখা হাসান ভাই’ বলে। পরস্পর তাঁরা পরম সখাই ছিলেন। দুজনের বিশ্ববীক্ষণ ছিল সমানুপাতিক। যারা কথাসাহিত্যের কাছে গল্পের অধিক কিছু প্রত্যাশা করে, পেতে চায় অস্তিত্ব ও জীবনের অভিনব মানে, পৌঁছাতে চায় হৃদয়োপলব্ধির গভীর কোনো স্তরে বিশেষ করে তারা অনুভব করবেন হাসান আজিজুল হকের অনুপস্থিতি।

তাঁর ভাষা ধীর লয়ের সেতার বাদনের মতো ধ্যানগম্ভীর। চিত্রকল্পে উপমায় উৎপ্রেক্ষায় প্রতীকতায় ও কাব্যময়তায় তার ছোটগল্প আর ছোটগল্প থাকেনি, তা হয়ে উঠেছে এক তুলনারহিত বাণীশিল্প। বাংলা সাহিত্যে তার তুলনা তিনি নিজেই। কী ভাবে লিখতেন হাসান ভাই? দীর্ঘ উদ্ধৃতি না দিলেই নয়:

সেই দিকে অন্ধকারের মধ্যে বিশাল ছায়ার মত মৃত গরুটি ভেসে ওঠে- ঘাড় তেমনি একদিকে কাত করা, পা গুলো ছড়িয়ে পড়া -তেমনি করুন অসহায় হয়ে সে মাটিতে আশ্রয় করে অন্ধকারে দুলছে। একটু বাতাস দিতেই করমালির মনে হল পালকের মতো হালকা ছায়াটা শূন্যে দুলে উঠলো এবং চোখের উপর ক্রমাগত কাঁপতে থাকলো। কিন্তু হাওয়া বন্ধ হতেই সে আবার মাটিতে নামে, সুস্থির হয়ে শুয়ে থাকে।

করমালি তখন তার পাশে মাটিতে বসে পড়ে। হাত বাড়িয়ে তার শঙ্খের মতো সাদা কোমল গলায় হাত রেখে আর সান্ত্বনা কাঁদে। এই ভাবে তার চোখ অন্ধকার হয়ে গেলে ছায়াটা আবার হারিয়ে যায়। তখন পিছনের দরজার উপর লাল আলো এসে পড়ে এবং গারো নীল রঙের শাড়ি পরা রহমালির মাকে দেখা যায়। তার হাতের কুপি থেকে গল গল করে ধোঁয়া বেরোচ্ছে এবং সে কুপিটাকে উঁচু করে ধলা গরু আর করমালিকে মনোযোগের সঙ্গে লক্ষ্য করছে।

তার শীর্ণ তোবরানো মুখ লালচে আলোয় প্রায় বীভৎস হয়ে উঠেছে। নগ্ন চোখ দুটো কপালের বাইরে চলে আসতে চাইছে । কিন্তু যেভাবে তার কুপি ধরা হাত উঁচু হয়ে আছে, ঠেলে বেরিয়ে আসা চোখ থেকে বিনত মায়াবী দৃষ্টি আছে তাতে করমালি সরাসরি ভেঙে পড়ে, “কি করবো কতি পারো রহমের মা ? আমি এহন কি করবো?”

কাঁদলি বাঁচপে? না। তবে কাঁদতিছ ক্যানো?

আমি কি করব বুঝতে পারতেছি নে।

গুমোট গরমের দিনে ঝিরঝির বৃষ্টির মতো রহমালির মা সেই অদ্ভুত প্রস্তাব করে, আমারে দিয়ে হয় না? কও। আমি তো দেহিছি দামরা না থাকলি দুধের গাই দিয়ে আবাদ করিছ জমি। এহন আমারে দিয়ে পারবা না? রহমালী পেটে ধরিছি তোমার সংসার টানতিছি এতদিন। আমি পারবানে দেহো তুমি। সূত্র- বিডিনিউজ

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে