এখানে চলে নারীদের হুকুমদারি, পুরুষের ভূমিকা শুধুই শয্যায়

প্রকাশিত: ২৭-০৭-২০২১, সময়: ১৪:৫৬ |
Share This

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : এশিয়ার বেশিরভাগ দেশ পিতৃতান্ত্রিক। পুরুষেরাই হন পরিবারের প্রধান। বাইরের কাজ সামলান ঘরের পুরুষ সদস্য আর সন্তান লালন পালন এবং ঘরের কাজ সামলানো নারীদের কাজ। তবে দক্ষিণ পশ্চিম চীনে হিমালয়ের কোলে পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন মাতৃতান্ত্রিক এক সম্প্রদায়ের নাম মসুও। অঞ্চলটি তথাকথিত নারী শাসিত এক অভিনব সাম্রাজ্য।
চীনের ইউনান প্রদেশে পাহাড়ের কোলে মসুও সমাজে নারীরাই সর্বেসর্বা। তাদের সমাজে পুরুষরা গৌণ। পুরুষের যৌন সঙ্গ ছাড়া যেহেতু সন্তান উৎপাদন সম্ভব নয়, তাই মসুও সমাজে পুরুষের প্রয়োজন ভবিষ্যত বংশধর তৈরির জন্য। এর বাইরে পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ককে তাদের সমাজে নিরুৎসাহিত করা হয়।

মাতৃতান্ত্রিক সমাজ বলতে বোঝায় যেখানে পরিবারের দায়িত্ব থাকে একজন নারীর উপর এবং বংশের ধারাও নির্ধারিত হয় নারীর দিক থেকে। মোটের উপর সম্পদের দায়িত্বও মা থেকে মেয়ের উপর বর্তায় এবং বিয়ের পর পুরুষ চলে যান নারীর ঘরে। তবে রাজনৈতিক এবং সামাজিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব থাকে পুরুষের কাঁধে। আর তারা এটাকে বিবেচনা করে ক্ষমতার সুষম বণ্টন হিসেবে।

মায়ের নেতৃত্বে বড় পরিবারে থাকতে অভ্যস্ত মসুও সম্প্রদায়ের মানুষেরা৷ তাদের মধ্যে ‘স্বামী’ বা ‘পিতা’ বলে কিছু আসলে নেই। এই সম্প্রদায় ‘ওয়াকিং ম্যারেজে’ বিশ্বাসী, অর্থাৎ একজন পুরুষ চাইলে একজন নারীর বাড়িতে যেতে পারেন এবং রাতটি তার সঙ্গে কাটাতে পারেন। তবে স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে বসবাসের বিধান নেই এই সম্প্রদায়ে। শুধু এই সম্প্রদায় নয় আরো অনেক দেশে এমন অনেক জাতি আছে যাদের সমাজ মাতৃতান্ত্রিক।

এখানকার রয়েছে আজব এক সমাজ ব্যবস্থা! কোনো বিয়ে শাদীর দরকার নেই। দরকার নেই কোন সামাজিক স্বীকৃতির। কোনো মেয়ে যদি রাতে তার ঘরে কোনো পুরুষকে আমন্ত্রণ জানায়, তাহলে সেই পর পরুষটি হয়ে যায় এক রাতের জন্য ওই মেয়ের স্বামী। এমন রীতিই প্রচলিত আছে মসুও সম্প্রদায়ে। তবে কোনো নারী চাইলে যে কোনো পুরুষকে বিয়ে করতে পারেন। মসুও কোন নারী কোন পুরুষকে আমন্ত্রণ দিলে সেই পুরুষ যদি নারীর সঙ্গে থাকতে চায় এবং তাদের ঔরসে যদি কোনো সন্তান হয় তবে তাকেই স্বামী হিসেবে মেনে নেয় ওই নারী। এ ধরনের বিয়েকে ‘ওয়াকিং ম্যারেজ’ বা’ হাঁটা বিয়ে’ নাম দিয়েছে সমাজবিজ্ঞানীরা।

চীনের ইউনান ও সিচুয়ান প্রদেশে এদের সংখ্যা ৩ লাখ ২০ হাজার। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে গ্রামটি প্রায় ২,৭০০ মিটার উঁচুতে। নিকটবর্তী যে কোনো শহর থেকে সেখানে যানবাহন যোগে পৌঁছতে কমপক্ষে ছয় ঘন্টা সময় লাগে। সম্ভবত এই দূরত্ব ও বিচ্ছিন্নতাই এখানে আলাদা প্রথা ও রীতিনীতি গড়ে তুলতে সহায়তা করেছে, যা পৃথিবীর অন্য কোথাও পাওয়া যায় না।

মসুও সমাজে পুরুষদের তেমন কোনো কাজ নেই। শুধুমাত্র সন্তান লালন-পালন ও পশু শিকারের কাজে তাদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। ফলে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষরা দিনের বেলায় গ্রামের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ায় এবং নারীদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে। যদি কোনো নারী তাদের রাতের বেলা নিজগৃহে যাওয়ার অনুমতি প্রদান করে তবে সন্ধ্যার পর তিনি সেই নারীর ঘরে যেতে পারেন। তবে শর্ত হচ্ছে, সূর্যোদয়ের আগেই সেই পুরুষকে নারী গৃহ ত্যাগ করতে হবে।

এই সম্প্রদায়ের নারীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের কমতি নেই। এটা কিন্তু তাদের স্বভাবজাত। এরা কিন্তু সেভাবে শিক্ষিত নয়, এরা কৃষক, কিন্তু আত্মবিশ্বাসে এরা যেন টগবগ করছে! এই জনগোষ্ঠীতে নারীরা দারুণ ক্ষমতাশালী। সন্তান লালন পালনের দায়িত্ব থাকে নারীর ওপর। সন্তানের মামা-খালারাই সন্তানের অভিভাবকত্বের বিবেচনায় প্রথমে আসেন। তারাই পিতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। অর্থাৎ সন্তানের ওপর পিতার অধিকার থাকে খুব সামান্য পরিসরে। এমনকি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সন্তানরা তাদের পিতার নামই জানেন না। মাতৃপরিচয়ে বড় হয়ে ওঠে। নামের শেষে মায়ের বংশ পরিচয় যুক্ত করে। সম্পদের উত্তরাধিকারও নারীর বংশ অনুসারে নির্ধারিত হয়ে থাকে।

মসুও পরিবারে শিশুরা যেহেতু মায়ের বাড়িতে বেড়ে ওঠে, তাই ঘরে পুরুষ বলতে বাবার চেয়ে তারা বেশি চেনে মামাকে বা মায়ের বংশের যে পুরুষ সেই পরিবারে থাকেন – তাকে। সন্তানের বাবার পিতৃত্বে কোন অধিকার থাকে না। আমরা বাবা বলতে যেটা বুঝি মসুও সমাজে বাবারা কিন্তু সেরকম নয়। সন্তানের বড় হয়ে ওঠার ব্যাপারে তাদের কোনোই দায়িত্ব থাকে না। সব দায়িত্ব নেন মামারা। বোনের বাচ্চাদের মসুও সংস্কৃতি সম্পর্কে শিক্ষা দেয়া, তাদের জীবনযাপন, মূল্যবোধ সবকিছু যথাযথভাবে শেখানোর দায়িত্ব মামাদের।

পরিবার পরিচালনার পাশাপাশি ব্যবসায়িক কাজেও নারীদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হয়। মসুওদের প্রধান অর্থনৈতিক উৎস কৃষি। নারীরাই সেক্ষেত্রে কৃষক। তারা প্রতিদিন ৭ ঘন্টা ও বছরে ৭ মাস কৃষি কাজে ব্যয় করেন। জমি চাষের পাশাপাশি তারা পশু পালনও করে থাকেন। অবশ্য পশু পালনে কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুরুষদের সম্পৃক্ততা দেখা যায়। অনেকে আবার লুগু হ্রদ থেকে মাছ আহরণের সঙ্গেও জড়িত থাকে। এর চারপাশে চমৎকার ঝাউবন। পাহাড়ে ঘেরা চোখ জুড়ানো দারুণ এলাকা।

মনে প্রশ্ন আস্তেই পারে, এমন পর্বত বেষ্টিত উঁচু ভূমিতে মসুওরা কীভাবে এবং কখন থেকে বসবাস করে আসছে। গবেষকদের মতে, এই পাহাড়ি পথ দিয়ে কোনো এক যুদ্ধের জন্য চেঙ্গিস খানের সেনাবাহিনী যাচ্ছিলো। এ সময় তারা লুগু হ্রদ ও এই গ্রামের সন্ধান পান। তারা এখানকার সৌন্দর্য দেখে বিমোহিত হয়ে পড়েন। তখন তাদের একটি অংশ এখানে থেকে যান এবং বসতি স্থাপন করেন। তাদের থেকেই মসুও জনগোষ্ঠীর বিকাশ।

শুধু মাতৃতান্ত্রিক পরিবার বলেই এটিকে ‘নারীর রাজ্য’ বলা হয় না, সত্যি সত্যিই মসুও সমাজে একজন রানি আছেন। তিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। সমগ্র গ্রাম তার নির্দেশে পরিচালিত হয়। মসুওদের পরিভাষায় তাকে বলা হয় ‘আহ মি’। এসব কারণেই মসুওদের গ্রাম খেতাব পেয়েছে ‘দ্য কিংডম অব উইমেন’ হিসেবে। ভবিষ্যত প্রজন্মে পরিবারের মাথা কে হবে, সেটা কোন কন্যাসন্তান পরিবারের অগ্রজ, সেটা বিচার করে তারা ঠিক করে না। পরিবারে যে কন্যা সন্তান সবচেয়ে বুদ্ধিমতী, আর সবচেয়ে পরিশ্রমী সেই পরিবারের মাথা হয়।

কঠোর ধর্মবিশ্বাস আর সংস্কৃতি কেন্দ্রিক তাদের জীবনযাপন। বছরে নির্দিষ্ট একটি দিনে মসুও নারীরা তাদের প্রথাগত উজ্জ্বল সাজপোশাক পরে তাদের পাহাড়ের দেবীর উৎসব উদযাপন করেন। তারা খুব মজা করে নাচ-গান করে, আগুন জ্বালিয়ে খাবার রান্না করে আর পর্বতের দেবীর সামনে ধূপ জ্বালাতে সবাই পাহাড় ভেঙে উপরে উঠে আসে। পাহাড়ের মাথায় তাদের দেবী ‘গামু’র মন্দির। তাদের বিশ্বাস এই দেবীই তাদের রক্ষাকর্ত্রী। এই দেবী নাচগান ভালোবাসেন, মদ্যপান, বহুগামিতা তার খুব পছন্দ। তাই এই দেবীকেই তারা অনুসরণ করে। দেবীর মতোই তারা একাধিক পুরুষসঙ্গী চায়।

তবে নারীদের এত ক্ষমতা আর পুরুষদের অবহেলা থাকলেও তাদের কোনো আক্ষেপ নেই। নারীদের প্রতি মসুওদের সম্মানবোধ মুগ্ধ করবে যে কাউ কেই। মসুও সমাজে পুরুষরা ছোটবেলা থেকেই নারীদের সম্মান করতে শেখে। নারীর প্রতি সম্মানবোধ নিয়ে তারা বেড়ে ওঠে,” বলেন চু ওয়াই হং।

যে কর্মপরিবেশে, যে সমাজে তিনি বড় হয়ে উঠেছেন, সেখানে দেখেছেন, প্রচুর পুরুষ সহকর্মীর মধ্যে কোনো মেয়ের বক্তব্য তুলে ধরা কতবড় একটা সংগ্রাম। তাই বলে মসুও নারীরা কিন্তু পুরুষদের কখনই হেয় করেন না। পুরুষপ্রধান দুনিয়ায় পুরুষরা নারীদের প্রতি যেভাবে আচরণ করে, তাদের যে চোখে দেখে, মসুও সমাজ নারীপ্রধান হলেও নারীরা কিন্তু পুরুষদের একইভাবে দেখে না। তারা পুরুষের ওপর প্রভুত্ব করে না। পুরুষদের গালমন্দ করে না। তাদের প্রতি মসুও নারীরা খুবই মমতাশীল। পুরুষরাও সেই সমাজে কখনও নিজেদের অধস্তন বা অবদমিত বলে মনে করে না।

২০১৫ সালে এই অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা যুক্ত করে চীন সরকার। সেই থেকে মসুওদের রাজ্যে প্রচুর পর্যটকের আগমন ঘটছে। গ্রামবাসীরা হ্রদের পাশে পর্যটকদের জন্য হোটেল নির্মাণ করেছে। যেসব পরিবারের বাড়ি সুন্দর সুন্দর জায়গায় তারা ইতিমধ্যেই বেশ সম্পদশালী হয়ে উঠেছে। যানবাহন এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা হয়েছে।

আবার মসুও এলাকায় এখন পর্যটকের সংখ্যা বাড়ার ফলে তারা এখন চীনের আধুনিক জীবনধারার সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগ পাচ্ছেন। অনেক মসুও নারী একজন জীবনসঙ্গীর সঙ্গে ঘর বাঁধার আইডিয়াও পছন্দ করতে শুরু করেছেন। অনেক যুবক গোত্রের বাইরের মেয়েদের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছেন।

তবে সমাজে নারীর সম্পর্কে পুরুষের যে প্রচলিত ধ্যানধারণা রয়েছে প্রাচীন এই মসুও সমাজ তার অনেক কিছুকেই চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে। এই আধুনিকায়নের যেমন ইতিবাচক দিক রয়েছে, তেমনি এর নেতিবাচক দিকও রয়েছে। ইতোমধ্যেই মসুও যুবক-যুবতীরা আধুনিকতার ছোঁয়া পেয়ে নিজেদের প্রথা ও ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুত হতে শুরু করেছে।

  • 2
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
উপরে