বাংলা ফ্যাশনের ফেরিওয়ালা

প্রকাশিত: ০১-০১-২০২১, সময়: ১৮:১৭ |
Share This

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : বাংলাদেশের মত একটি উন্নয়নশীল দেশ নারীদের অধিকার এখনো পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। ঠিক সেখানেই পুরুষদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নিজেকে বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করা এতো সহজ ছিলোনা। দেশে সবক্ষেত্রে নারীরা সমান অবদান রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করলেও অনেকক্ষেত্রেই পেরুতে হয় নানা বাধা-বিপত্তি আর কাঠখর। আর এমনি কিছু হাতেগোনা কঠোর পরিশ্রমী মানুষ নিজেদের অবস্থান আর নিজের মাতৃভূমিকে বিশ্বদরবারে কাছে উপস্থাপন করেছে অনন্য নামে।

বিবি রাসেল একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাংলাদেশী ফ্যাশন মডেল এবং নকশাকার। তিনি একজন মডেল হিসেবে ইউরোপে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। অনেকের কাছেই তিনি ‘বিবি আপা’ নামে পরিচিত।

দেশে-বিদেশে ফ্যাশন আইকন হিসেবে নিজের নাম লেখান সবার পরিচিত বিবি রাসেল। তিনি বিশ্বব্যাপী নিজেকে যেমন নিয়ে গিয়েছেন খ্যাতির শিখরে, তেমনি বাংলাদেশকেও বসিয়েছেন সম্মানের আসনে।

বাংলাদেশে ২০০০ সালের পর থেকেই পোশাক পোশাকশিল্প উন্নতির পথে। সেই সময় থেকে দেশের অর্থনীতি ব্যাপকভাবে এই পোশাকশিল্পের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। কেবলমাত্র পোশাক তৈরি নয়, ডিজাইনের ক্ষেত্রেও এই অগ্রযাত্রা সমানভাবে প্রযোজ্য। আর এই ডিজাইনের ক্ষেত্রে এক অনন্য উচ্চতায় আসীন বিবি রাসেল।

জন্ম ও পরিবার

বিবি রাসেল চট্টগ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৫০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তার পরিবারের ৫ সন্তানের মধ্যে তৃতীয়। পিতা পরলোকগত মুখলেসুর রহমান এবং মাতা শামসুন্নাহার রহমান। বিবি রাসেলের মাতা-পিতা দু’জনই সংস্কৃতিপ্রিয় মানুষ ছিলেন।

রাসেলের স্কুল জীবন কাটে কামরুন্নেসা সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী হিসেবে। পরবর্তীতে তিনি ছিলেন গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ, আজিমপুর, ঢাকার ছাত্রী। ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি উচ্চতার বিবি রাসেলের ফ্যাশন চিন্তায় উজ্জ্বল এবং রঙিন বর্ণের সমাহার লক্ষণীয়। তিনি ফ্যাশন ডিজাইনের উপর গ্রাজুয়েশন ডিগ্রী অর্জন করেন লন্ডনের লন্ডন কলেজ অফ ফ্যাশন থেকে, ১৯৭৫ সালে। ২০০৪ সাল পর্যন্ত তার প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের গ্রাম্য এলাকায় ৩৫,০০০ তাঁতীকে চাকরি দেন। সর্বশেষে লন্ডনের কলেজ অভ ফ্যাশন অ্যান্ড ডিজাইন থেকে পড়াশোনা শেষ করেন। পরবর্তী পাঁচ বছর তিনি বিভিন্ন নামকরা ম্যাগাজিনের টপ মডেল ছিলেন, যার মধ্যে ভোগ, কসমোপলিটন উল্লেখ্য।

১৯৯৪ সাল পর্যন্ত তিনি নামকরা বিদেশি ডিজাইনার, যেমন- আরমানি, সেইন্ট লরেন্ট, কোকো শ্যানেল, কেঞ্জো- এদের সাথে ফ্যাশন শোতে কাজ করেন এবং সেই বছরই দেশে এসে তিনি ‘বিবি প্রোডাকশন’ নামে নিজস্ব ব্র্যান্ড চালু করেন। তার এই ফ্যাশন হাউজের মূল লক্ষ্য ছিল দেশের একদম নিজস্ব সংস্কৃতিকে পৃথিবীর বুকে তুলে ধরা। ২০০৪ সালের মধ্যে তিনি প্রায় ৩৫,০০০ গ্রামীণ পোশাকশিল্পীকে নিজের সাথে যুক্ত করতে সক্ষম হন।

প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে বিবি রাসেল ১৯৭২ সালে লন্ডন কলেজ অভ ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে যোগ দিতে যান। ক্লাস শুরুর ছয়মাস আগেই তিনি চলে যান, কিন্তু ইংরেজি পাঠ্যক্রমের কোনো সার্টিফিকেট না থাকায় তিনি ভর্তির জন্য অনুপযুক্ত ছিলেন। প্রতিদিন তিনি অফিসে ফোন দিতে থাকলেন এবং একসময় তিনিসহ আরো কয়েকজন প্রার্থীকে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হয়। তিনি সেদিন বাংলাদেশের পোশাক, ডিজাইন, ফ্যাশন নিয়ে করা মৌলিক কিছু প্রশ্নের উত্তর দেন; যদিও প্রাতিষ্ঠানিক ধারণা না থাকায় কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যর্থ হন। এসময় তাকে অতিরিক্ত ক্লাসগুলোতে অংশ নেয়ার শর্তে ভর্তি হবার সুযোগ দেয়া হয়।

৫ ফুট ১০ ইঞ্চি উচ্চতার এই মডেল অল্প ক’দিনের মধ্যেই তার কাজের প্রতি আগ্রহ এবং বুদ্ধিদীপ্ততার জন্য পরিচিত লাভ করেন। অন্যদিকে তামাটে রঙ, লম্বা চুল, আর প্রাচ্যের সংস্কৃতির মিশ্রণে তিনি সেসময়ে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কাজ করেন। এর মধ্যে টয়োটা, জাগুয়ারের জন্য করা মডেলিং ছিল অন্যতম। সবকিছুর পরেও যেকোনো নতুন কাজের জন্য তার আগ্রহ ছিল অপরিসীম এবং নিত্যনতুনভাবে নিজেকে আবিষ্কারের নেশা ছিল তার। একবার একটি শ্যাম্পুর মডেলিংয়ের জন্য সুইমিংপুলে উঁচু জাম্পবোর্ড থেকে লাফ দিতে হয়। এরকম কাজ আগে না হওয়ায় তাকে টানা ১০ দিন অনুশীলনের মধ্য দিয়েও যেতে হয়।

১৯৯৪ সালে তিনি দেশে আসেন। ক্যারিয়ারে প্রথম থেকেই বিবির ইচ্ছা ছিল, বাংলাদেশের পোশাক শিল্প এবং ফ্যাশন নিয়ে কাজ করবেন। দেশে ফিরে তিনি তার বাবা-মাকে তার ইচ্ছার কথা জানান এবং লোকজনের নানা কটূক্তি সত্ত্বেও তারা বিবিকে সাহায্য করেন। প্রায় দেড় বছর তিনি দেশের প্রতিটি আনাচে-কানাচে ঘোরেন এবং হস্তশিল্পীদের সাথে কথাবার্তা বলেন। তখনও তারা কেউই বিশ্বাস করতে চাননি; কেননা তাদের ধারণা ছিল, বিবিও হয়তো নেহাত বুলি খরচ করে চলেছেন।

কিন্তু প্রায় দেড় বছর দেশের আনাচে-কানাচে সব পোশাক-শিল্পীর সাথে কথা বলে তিনি তাদের বিশ্বাস অর্জন করেন এবং নিজের কাজ শুরু করেন। সেই শুরুর পর থেকে কখনও পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। প্রায় একা হাতেই সামলে যাচ্ছেন নিজের বিবি প্রোডাকশন। অর্জন করেছেন দেশ-বিদেশের অসংখ্য সম্মাননা এবং স্বীকৃতি।

কখনো বাংলা একাডেমির ‘সম্মানিত ফেলো’, কখনো হয়তো এল ম্যাগাজিনের ‘বর্ষসেরা নারী’। ২০১০ সালের সেরা চলচ্চিত্র ‘মনের মানুষ’-এর পোশাক পরিকল্পনাকারী হিসেবে জাতীয় পুরস্কারও জিতে নেন তিনি। ২০১৫ সালে নারী জাগরণ, আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার বিবি রাসেলকে বেগম রোকেয়া পদকে ভূষিত করেন।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
উপরে