জিতেছি যতটা, হেরেছিও ততটা!
দেবাশীষ কুন্ডু : বিজয়ের মাস এলে ১৯৭১ সালকে স্মরণ করতে হয়। ডিসেম্বর আনন্দমুখর হয়ে ওঠে; তার অন্তরালে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর দ্বারা সংঘটিত গণহত্যার নির্মম স্মৃতি বাংলার জনপরিসরে অন্ত:সলিলা নদীর মতো প্রবহমান থাকে। এ বছর বিজয়ের দিনে আমরা খানিকটা হালকা বোধ করছি কেননা যুদ্ধাপরাধীদের শীর্ষস্থানীয়দের অনেকেরই বিচারের রায় কার্যকর হয়েছে।
অন্তত: আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিজামী, সাকাদের আর সংসদ সদস্য পদে দেখতে হবেনা। যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক ভবিষ্যত কেবলমাত্র নির্বাচন কমিশন আর আদালতের মাধ্যমে সুরাহা হবেনা। বাংলার সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিসরে তাদের সমব্যথীরা এখনো সক্রিয়। উপযুক্ত পরিবেশ পেলে তারা আবার স্বরূপে আবির্ভূত হতে দেরি করবে না।
একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বেড়েছে, তবুও এইসব সূর্যসন্তানদের মর্যাদা এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। জীবনযুদ্ধে পরাজিত অ-রাজনৈতিক মুক্তিযোদ্ধাদের মুখ আমাদের গ্লানি বাড়ায়, মানচিত্র ভারাক্রান্ত হয়। ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আর রাজনৈতিক ক্ষমতা মুখোমুখি দাড়িয়ে যায়। স্বাধীনতার প্রথম দশকের মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধের প্রতি-বয়ান রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসর পাল্টে দিতে থাকে। ’বঙ্গবন্ধু আর জয় বাংলা’ দেশের অভ্যন্তরে নির্বাসিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধের প্রতি-বয়ান প্রচন্ড দাপটে মুক্তিযুদ্ধকে এর সংগঠকদের থেকে আলাদা করতে থাকে। এমন এক বাংলাদেশ রাষ্ট্র গড়ে উঠতে থাকে, যার মধ্যে পাকিস্তানি সামরিক কুলাঙ্গারদের প্রতি সহানুভূতিশীল কয়েকটি প্রজন্ম জন্ম নেয়। খুব আস্থার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধকে ইসলামের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাড় করানো হয়। শাহবাগের গণ জাগরণও এই প্রতি-বয়ানের নির্মম শিকারে পরিণত হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত সংবিধানের চারটি মূল উপাদানের অন্তত: দুটি নিয়ে ধোঁয়াশা কোনোদিন কাটেনি। সমাজতন্ত্র বলতে বাংলাদেশ রাষ্ট্র কী বোঝে? আর ধর্মনিরপেক্ষতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পার্থক্য না করতে পারার রাজনৈতিক ব্যর্থতা আমাদের আজো পোড়ায়। প্রবলভাবে রাজনৈতিক একটি বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের অনুপস্থিতি রাষ্ট্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে নানাভাবে।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের দমকা ঘোড়ার সাথে সামাল দিতে গিয়ে সমাজ তালমাতাল হয়ে উঠছে। মুক্তিযুদ্ধের এক বড় অঙ্গীকার- সাম্য। সেই সাম্য কোথাও এসেছে কি? শিক্ষায়, স্বাস্থ্যে, আয়ে, সুযোগ-সুবিধায়। অবকাঠামো আর তথ্য-প্রযুক্তি খাতে সুবাতাস বইছে, কিন্তু তার সুফল তোলার পরিসর এখনো তৈরি নয়।
রাজনৈতিক বিভাজন সমাজকে মারাত্মকভাবে খন্ডিত করেছে। প্রথাগত সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা পালন করার জন্য বিকল্প অনেক তৈরি হয়েছে বটে, তবে সেগুলোও কতটা পারছে- তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। সবচেয়ে বড় কথা- আমরা, এই সমাজের বাসিন্দারাই ধরে নিয়েছি- আমরা সবাই সমান নই। জর্জ অরওয়েলের গাধারা আমাদের চেয়ে একটু বেশিই সমান!
লেখক- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক। সূত্র- বাংলা ইনসাইডার