নাটোরের খায়রুল হত্যার বিচার নিয়ে শংকিত নিহতের পরিবার

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২০; সময়: ১১:২৭ পূর্বাহ্ণ |
নাটোরের খায়রুল হত্যার বিচার নিয়ে শংকিত নিহতের পরিবার

নবীউর রহমান পিপলু, নাটোর : জামায়াত-শিবির ক্যাডারদের তান্ডবের বলি নাটোরের লালপুর উপজেলার কদিমচিলান গ্রামের যুবলীগ নেতা খাইরুল ইসলাম হত্যাকান্ডের বিচার নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন নিহতের পরিবার। যুদ্ধাপরাধী সাঈদির রায়ে সংঘঠিত তান্ডবের ৭ বছর পুর্ন হচ্ছে আজ। ২০১৩ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারী জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন নায়েবে আমীর দেলোয়ার হোসেন সাইদীর বিরুদ্ধে যুদ্ধপারাধ মামলার রায় ঘোষণার দিন জামায়াত-শিবির ক্যাডাররা কদমচিলান ইউনিয়ন যুবলীগ সাধারন সম্পাদক খাইরুল ইসলামকে তার নিজ বাড়িতে কুপিয়ে হত্যা করে জামায়াত শিবিরের সশস্ত্র নেতাকর্মীরা।

এছাড়া খাইরুলের এক ভাইকে কুপিয়ে আহত করা হয়। আগুন দেয়া হয় তাদের বাড়ি সহ আত্মীয় সজনদের বাড়িতে। এদিন জামায়াত শিবিরের সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী পুলিশের ওপর হামলা করে পুলিশের কয়েকটি অস্ত্র ও গোলাবারুদ ছিনিয়ে নিয়ে পুলিশের গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এসব ঘটনায় পুলিশ ও নিহত খাইরুলের মামলা হলে পরিবারের পক্ষ থেকে দায়ের করা হত্যা মামলা দ্রুত বিচার আইনে বিশেষ ট্রাইবুনালে স্থানান্তর হলেও সাক্ষগ্রহণ চলাকালীন মামলার কার্যক্রমে হঠাৎ স্থগিতাদেশ জারি করে উচ্চ আদালত। ওই ঘটনার সাত বছর হতে চললেও থমকে আছে খাইরুল হত্যা মামলার বিচার প্রক্রিয়া।

উচ্চ আদালতে আসামীপক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে বিচারিক কার্যক্রম স্থগিত হওয়ার পর বিচার পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগছেন নিহতের স্ত্রী ও তার পরিবারের লোকজন। বিচারিক কার্যক্রম থেমে যাওয়ার পর এখন মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করতে গিয়ে কোনো নথি খুঁজে পাচ্ছেন না ভুক্তভোগী পরিবারটি। বিচার পাওয়া নিয়ে হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়েছেন নিহত খাইরুলের স্ত্রী ফাবিয়া বেগম লিপি। এখন শুধু নিরব কান্না তার সঙ্গি। নিহত স্বামীর ফটো বুকে আঁকড়ে ধরে স্বামী হত্যাকারীদের বিচারের প্রত্যাশায় দিন কাটাচ্ছেন। এদিকে উচ্চ আদালতে বিচারিক কার্যক্রম স্থগিত হওয়ার পর মামলার আসামীরা মামলা তুলে নিতে বাদি সহ নিহতের পরিবারকে চাপ দিচ্ছে। কোটি টাকার অর্থের লোভ দেখানোর পাশাপাশি হুমকিও দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ নিহত খাইরুলের পরিবারের।

জামায়াত নেতা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর যুদ্ধাপরাধ মামলার রায়কে কেন্দ্র করে সারাদেশে তান্ডব চালায় জামায়াত-শিবির নেতা-কর্মীরা। ওই তান্ডবে নাটোরের লালপুর উপজেলার কদিমচিলান গ্রামের যুবলীগ নেতা খাইরুল ইসলামসহ সারাদেশে নিহত হন অন্তত ৪২ জন। সেদিন রায় ঘোষণার পর জামায়াত-শিবিরের সশস্ত্র নেতাকর্মীরা লালপুরের কদিমচিলান বাসস্ট্যান্ড থেকে মিছিল বের করে। তারা পুলিশের ওপর চড়াও হয়ে তাদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ কেড়ে নিয়ে টহলগাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। এসময় জামায়াত-শিবিরের হামলায় লালপুর থানার উপ-পরিদর্শক আবদুর রউফ, হাবিলদার আবদুল মান্নান, কনস্টেবল সাইদুর রহমান গুরুতর জখম হন।

এরপর জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা পাশের পুকুরচিলান গ্রামে যুবলীগ নেতা খাইরুলের চাচা অবসরপ্রপ্ত সার্জেন্ট মজনুর রহমানের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। বাড়িতে থাকা মজনুর রহমানকে বাইরে বের করে কোপাতে থাকে তারা । সেসময় পাশে নিজের বাড়িতে দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন খাইরুল। চাচার চিৎকার শুনে ঘর থেকে বের হওয়া মাত্রই খাইরুলকেও উপর্যুপরি কোপাতে থাকে ইউনিয়ন জামায়াত নেতা আব্দুল করিম, মতি সরদার ও আবুল কালাম আজাদসহ অন্তত ৬০ সশস্ত্র শিবির ক্যাডাররা। গুরুতর আহত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়লে খাইরুলকে হামলাকারীরা লাঠিসোটা দিয়ে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করে। হামলার সময় দেবর শাহীনুর রহমানের সাথে ছেলে জুবায়ের হোসেন লিখন ও কন্যা খাদিজাতুল কোবরাকে নিয়ে পাশের এক শিক্ষিকার বাড়িতে পালিয়ে গিয়ে প্রাণ বাঁচান খাইরুলের স্ত্রী ফাবিয়া বেগম লিপি।

ঘটনার রাতে খাইরুলের ভাই শাহীনুর রহমান বাদী হয়ে ৬২ জনের নাম উল্লেখ করে লালপুর থানায় একটি এজাহার দায়ের করেন। পরবর্তীতে একই বছরের ৬ মার্চ আরও ৫৪ জনের নাম উল্লেখ করে অপর একটি এজাহার দায়ের করেন খাইরুলের চাচা মজনুর রহমান। শাহীনুর রহমানের দায়ের করা এজাহারে আব্দুল করিম, মতি সরদার, আবুল কালাম আজাদ, মিজানুর রহমান, মখলেস সরদার, মহসীন, খলিল, রানা, সানা, আনিসুর, রাজ্জাক, জারজিস, কালাম, আকরামসহ জামাত-শিবিরের ৬২ নেতাকর্মী ও মজনুর রহমানের এজাহারে কদিমচিলান ইউপি জামাতের সভাপতি মোখলেস সরদার, রানা, মকবুল প্রামানিক, বানছার আলী, আব্দুল কুদ্দুস, রুস্তম আলী, সাগর,লুঃফর, হজরত, প্রিন্স, সুইট, মহসীন, করিমসহ সহ আসমী করা হয় জামাত-শিবিরের ৫৪ নেতাকর্মীকে। বিধি অনুযায়ী দুইটি এজাহার একত্রিত করে একটি মামলা গ্রহণের নিয়ম থাকলেও পরবর্তীতে তদন্তকারী কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক আনিসুর রহমান পৃথকভাবে দুইটি এজাহারকে দুইটি মামলায় রুপান্তরিত করেন।

পরে ২০১৬ সালের ২৬শে অক্টোবরমামলা দুটি দ্রুত বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইবুনাল আদালত রাজশাহীতে স্থানান্তর হয়। শুরু হয় মামলার বিচারিক কার্যক্রম। মামলার সাক্ষীদের সাক্ষগ্রহণ শুরু হলে জামিনে মুক্তি পায় মামলার সকল আসামী। বের হয়েই মামলা প্রত্যাহারে তৎপরতা শুরু করে তারা। হঠাৎ ২০১৭ সালের ১৮ জুলাই মামলার আসামী কদিমচিলান ইউনিয়ন জামায়াতে ইসলামীর সভাপতি মোখলেসুর রহমানের আবেদনের প্রেক্ষিতে বিচারপতি মিফতাহ উদ্দীন চৌধুরী ও আ ন ম বশির উদ্দীনের হাইকোর্ট ব্রেঞ্চ মামলার কার্যক্রমে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। এই নিষেধাজ্ঞার পরই থেমে যায় মামলার বিচারিক কার্যক্রম। অপরদিকে পুলিশের ওপর হামলা ও অস্ত্র লুট সহ গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করার ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে জামায়াত-শিবিরের স্থানীয় ৮৫ নেতাকর্মীর নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ২৭৪৭ জনকে আসামী করে দুইটি মামলা দায়ের করে।

নিহত খাইরুল পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হওয়ায় তার মৃত্যুতে পথে বসার উপক্রম হয় পরিবারের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই বছর আগস্ট মাসে খাইরুলের পরিবারকে ১০ লাখ টাকার আর্থিক সহায়তা দেন। ওই টাকা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে তার মুনাফা দিয়ে চলছে স্ত্রী-সন্তানের ভরণপোষণ ও পড়ালেখার খরচ। খাইরুলের ছেলে জুবায়ের হোসেন লিখন ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র ও কন্যা খাদিজাতুল কোবরা এবার এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে এবং ছোট মেয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে।

খাইরুলের চাচা অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট মজনুর রহমান বলেন, উচ্চ আদালত মামলার ৫ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ চলাকালে স্থগিতাদেশ দিয়েছে। এখন মামলার আসামীরা জামিনে বাইরে রয়েছে। তারা বিভিন্নভাবে মামলা প্রত্যাহারে চাপ দিচ্ছে। মামলা প্রত্যাহার করলে এক কোটি টাকা দেয়ার প্রস্তাবও দিয়েছে ওরা। স্থগিতাদেশ বাতিল করে পুনরায় বিচার কাজ শুরু করার জন্য মামলার নথি চেয়ে হাইকোর্টের রেজিস্টার ও এটর্নি জেনারেলের দপ্তরে ধর্ণা দিয়েও কোন কাজ হয়নি।

মামলার বাদী শাহীনুর রহমান বলেন, মাঝপথে বিচারির কার্যক্রম থেমে যাওয়ায় আমরা হতাশ। হত্যাকারীরা অনেক শক্তিশালী। তাদের খুঁটির জোরে মামলার নথিও গায়েব হয়ে গেছে। আমাদের এখন আতংকে দিন কাটে। মামলার বাদী হওয়ায় দুই বার গুলি করে আমাকে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়।

খাইরুলের স্ত্রী ফাবিয়া খাতুন লিপি বলেন, প্রধানমন্ত্রী আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বলে সন্তানদের মানুষ করতে পারছি। প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ১০ লাখ টাকাই এখন তাদের সম্পদ। এখন স্বামী হত্যার বিচারটা চাই। যে দল করার জন্য আমার স্বামীকে জামায়াত-শিবির হত্যা করলো, সেই দল ক্ষমতায় থাকার পরও আমরা বিচার পাচ্ছি না। উপরুন্তু আসামী ও তাদের সজনরা কোটি টাকার লোভ দেখিয়ে মামলা তুলে নিতে চাপ দিচ্ছে। হুমকিও দিচ্ছে তারা।

নাটোর জজকোর্টের পিপি (পাবলিক প্রসিকিউটর) সিরাজুল ইসলাম বলেন, খাইরুল হত্যা মামলাটি গুরুত্বের সাথে নিয়ে নাটোর আদালতে বিচারিক কার্যক্রম শুরু করা হয়। সাক্ষীদের সমন পাঠিয়ে যখন মামলাটিতে গতি আনা শুরু হয়, তখন মামলাটি বিশেষ ট্রাইবুনালে স্থানান্তরিত হয়। বর্তমানে মামলার অগ্রগতি জানা বা তরান্বিত করার সুযোগ নেই। তবে প্রত্যাশা করি মামলাটি যেনো খুব দ্রুত শেষ হয় এবং খাইরুলের পরিবার ন্যায়বিচার পায়।

জেলা যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমীন বিপ্লব বলেন, জামায়াত শিবিরের নৃশংসতার শিকার যুবলীগ নেতা খাইরুল হত্যাকান্ডের বিচার উচ্চ আদালতে স্থগিত হওয়ার ঘটনাটি বেদনাদায়ক। জামায়াত-শিবিরের অর্থনৈতিক শক্তির কাছে যেনো আইন আত্নসমর্পণ না করে আমরা সেই প্রত্যাশা করছি।

নাটোরের পুলিশ সুপার লিটন কুমার সাহা ঘটনার প্রায় সাত বছরেও হত্যা মামলার বিচার না হওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারীর ঘটনায় পুলিশের দায়ের করা মামলার বিচার কাজ চলছে। নাটোরের জেলা ও দায়রা জজ আদালতে এই মামলার স্বাক্ষ্য গ্রহণ করা হচ্ছে। তিনি নিহত খাইরুলের পরিবারের নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখা হচ্ছে বলে জানান।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে