বখাটের হাতে নিহত সেই কনিকার বোনের ধুমধামে বিয়ে

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২০; সময়: ১১:৫৬ পূর্বাহ্ণ |
বখাটের হাতে নিহত সেই কনিকার বোনের ধুমধামে বিয়ে

নিজস্ব প্রতিবেদক, চাঁপাইনবাবগঞ্জ : চলমান শতাব্দির ১৬ সালের ২৭ মে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের মহিপুরে বখাটে হামলায় মারা যান স্কুল ছাত্রী কনিকা রানী দাস। তার ছোট বোন কাঞ্চনা রানী দাস তখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী। ওই ঘটনার মাত্র চার মাস আগেই মারা যান কাঞ্চনার বাবা লক্ষ্মন ঘোষ। এ অবস্থায় অকুল পাথারে ভেসে যায় তাদের পরিবারটি। গ্রামের দারিদ্রপীড়িত হিন্দুরা যখন পরিবারটির জন্য তেমন কোনো সহযোগিতা করতে পারছিলেন না, তখনই এগিয়ে স্থানীয় ইউপি সদস্য তাসেম আলী। কাঞ্চনার যাবতীয় দায়-দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন তিনি। সেই থেকে শুরু হয় তাসেম-কাঞ্চনার বাবা-মেয়ের সম্পর্ক। এবার মহা ধুমধামে সেই কাঞ্চনার বিয়ে দিলেন তাসেম আলী। রবিবার(১৬ ফেব্রুয়ারী) রাতে সম্পন্ন হয় বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা। পরের দিন সোমবার ছিলো বিয়ের ভোজ।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার গোবরাতলা ইউনিয়নের মহিপুর-ধাইনগর গ্রামের এই ঘটনাটি ধর্মীয় সম্প্রীতির এক অনন্য উদাহরণ হিসেবেই দেখছে এলাকাবাসী।

স্থানীয়রা জানান, কাঞ্চনার বড় বোন কনিকা হত্যার পর পরিবারটি অকুল পাথারে ভেসে যেতে বসেছিল। কনিকার হত্যার তৃতীয় দিন মহিপুরে কমিউনিটি পুলিশিংয়ের এক মত বিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই মত বিনিময় সভাতেই তার ছোট বোন কাঞ্চনার যাবতীয় ব্যয় ভার বহনের ঘোষণা দেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি তাসেম আলী। স্থানীয়দের অনেকেই সেদিন মনে করেছিলেন এই ঘোষণা শেষ পর্যন্ত ঘোষণায় থেকে যাবে, বাস্তবায়ন হবে না। কিন্তু পরবর্তীতে সেই ধারণা বদলে যায়। চার বছর পাশে থেকে লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করেছেন কাঞ্চনাকে।

কাঞ্চনাদের প্রতিবেশী জিল্লুর রহমান জানান, একটি হিন্দু মেয়ের দায়িত্ব নিচ্ছে একজন মুসলিম এমন মানসিকতা সবাই নাই। ধর্ম নিয়ে মানুষ কতই না বাড়াবাড়ি করে। কিন্তু এখানে দুই ধর্ম মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। তাসেম আলী ও কাঞ্চনাকে দেখে বোঝার উপায় নেই তারা দুই ধর্মের অনুসারী। বরং অজানা কেউ দেখলে তাদের সত্যিকারের বাবা-মেয়েই মনে করবে।

কাঞ্চনার নানা শ্রী সুকুমার চন্দ পাল জানান, এই গ্রামে বেশিরভাগই মুসলিম পরিবার। কিন্তু আমাদের মাঝে কোনো ভেদাভেদ নেই। আমরা ভাই-ভাইয়ের মতোই বসবাস করি। আমার নাতনির জন্য একজন মুসলিম যা করেছেন তা আমরা কখনোই ভুলব না। তিনি না থাকলে হয়তো পরিবারটির বেঁচে থাকায় দায় হয়ে যেত।

নতুন জীবন শুরুর প্রাক্কাল্যে কাঞ্চনার আবেগ যেন থামেই না। বললেন, আমার বাবা ছিল না। বোনকেও যখন হারিয়ে ফেলি তখনই তাসেম কাকু এসে আমার দায়িত্ব নেন। আজ পর্যন্ত কোনোদিন বুঝতে দেননি তিনি আমার বাবা নন। সব সময় বাবার আদর দিয়েই আমাকে বড় করেছেন। তার মেয়ে আর আমি দুইজনই বোনের মতো চলাচল করি। তার মতো মানুষ হয় না। তিনি আজ নিজে আমার বিয়ে দিয়েছেন।

কাঞ্চনার বর মানিক চান্দ বর্মন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তিনি জানালেন, সব কিছু জেনেই তিনি কাঞ্চনাকে বিয়ে করেছেন। বিয়ের আগেও তিনি কাঞ্চনার বাবা তাসেম আলীর সঙ্গে কথা বলেছেন। তাকে তিনিও বাবা ডাকেন। তাসেম আলী যেমন কাঞ্চনাকে মেয়ে হিসেবে পরিচয় দেন তেমন তাকেও জামাই হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন মানুষের কাছে।

কাঞ্চনাকে এতদিন যিনি লালন-পালন করেছেন সেই তাসেম আলীও আবেগ আপ্লুত। বললেন, ধর্ম নয়, মানুষ হিসেবেই মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। মেয়েকে একজন ভাল পাত্রের হাতে তুলে দিতে পেরে খুশি তিনি।

তিনি বলেন, আমি কখাই হিন্দু মুসলমান ভেদাভেদ করিনি। পরিবারটি বা মেয়েটি অসহায় ছিলো আমি পাশে দাঁড়িয়েছি। সারাজীবন বাবা হয়েই তার পাশে থাকবো।

কাঞ্চনার বোন কনিকা রানী হত্যা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় যে মামলা হয়েছিলো ২০১৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ওই মামলার রায় দেন আদালত। এতে একমাত্র হত্যাকারী আব্দুল মালেকের ফাঁসির আদেশ হয়। মামলাটি এখন উচ্চ আদালতে বিচারাধীন।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে